ধনুষ্টংকার একটা মারাত্মক সংক্রামক রোগ। এ রোগের জীবাণু ক্লসট্রিডিয়াম টিটেনি মানুষ ও পশুর মল মেশানো মাটিতে থাকে। এ রোগের জীবাণু বিষ (Toxin) স্নায়ুতন্ত্রকেআক্রান্ত করে।
ধনুষ্টংকার||ধনুষ্টংকার কেন হয়||ধনুষ্টংকার রোগের লক্ষণ
এ রোগকে অনেকে ভূতে ধরা বা প্যাচায় ধরা বলে। যে কোন বয়সে এ রোগ হতে পারে । পৃথিবীতে প্রতি বছর এ রোগে মৃত্যুর হার খুব বেশি। এর প্রধান শিকার শিশু এবং আমাদের মত গরীব ও অনুন্নত দেশের অধিবাসী।
টিকা না নিলে ১০০ জন শিশুর মধ্যে ১ জন ধনুষ্টংকারে মারা যায়। আক্রান্ত হলে সাথে সাথে চিকিৎসা করা জরুরী নতুবা মৃত্যুর আশংকা খুবই বেশি । প্রতিষেধক টিকা না নিলে শরীরের নোংরা বা ময়লাযুক্ত (Contaminated) কাটা বা ক্ষত অংশে এই রোগের জীবাণু সহজেই বংশ বিস্তার করে এবং রোগ দেখা দেয় ।
ধুনষ্টংকার কেন হয়
শরীরের কাটা বা ক্ষত অংশ যদি ঐ দূষিত মাটি বা ধূলার সংস্পর্শে আসে, তাহলে ধনুষ্টংকা র রোগের জীবাণু শরীরে প্রবেশ করতে পারে। নবজাতক শিশুদের বেলায় এই রোগের জীবাণু সাধারণত নাভি দিয়ে শরীরের মধ্যে প্রবেশ করে।
নোংরা ব্লেড, বাঁশের ছাল, ময়লা ভেজা সুতা, ছাই, গোবর, ধূলা, অপরিচ্ছন্ন কাপড়, অপরিষ্কার যন্ত্রপাতি দ্বারা নাভি কাটা, বাঁধা বা লাগানোর জন্য ব্যবহার করা হলে শিশুর এই রোগ হয় ।
রোগের সুপ্তাবস্থার সময়কাল
এই রোগের জীবাণু শরীরে প্রবেশ করার পরে ২ থেকে ৫ দিনের মধ্যে রোগের লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে। তবে গড়ে ১০-১৬ দিনের মধ্যে এ রোগ দেখা দেয় ।
রোগের লক্ষণসমূহ
১. মাড়ি বা চোয়ালের মাংসপেশীতে খিঁচুনী হয়। চোয়াল শক্ত হয়ে আসে, মুখ খুলতে অসুবিধা হয়, ফলে খেতে পারে না। শিশু মায়ের দুধ টানতে পারে না । এই অবস্থাকে চোয়ালে তালা লাগা বা লক’জ বলে ।
২. কপাল ও মুখ কুঁচকে এবং বেঁকে এক বিকৃত মুখভঙ্গী তৈরি হয়। এই অবস্থাকে ‘রাইসাস সারডনিকাস (Risus Sardonicus) বলে’। ল্যাটিন শব্দ ‘রাইসাস’ অর্থ হাসি এবং ‘সারডনিক’ অর্থ হলো ব্যঙ্গপূর্ণ। এই বিকৃত ব্যঙ্গপূর্ণ হাসিকে অনেকেই শয়তানের হাসি বলে ।
৩. ঘাড়, পিঠ ও পেঠের মাংস শক্ত হয়ে শরীর পিছন দিকে ধনুকের মত বেঁকে যায়। ধনুকের মত শরীর বাঁকা হয় বলে রোগটার নামকরণ হয়েছে ধনুষ্টংকা র ।
৪. রোগী অস্থির ও শক্ত হয়ে যায় এবং শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। সামান্যতম শব্দ, আলো এবং স্পর্শে খিঁচুনী হয় কিন্তু রোগী সজ্ঞান থাকে ।
৫. শিশুদের বেলায় রোগী অস্থির হয়ে যায়, অতিরিক্ত কাঁদে, খেতে চায় না, খেতে গেলেই খিঁচুনী শুরু হয়। এ ছাড়া উপরের লক্ষনগুলো সবই থাকে ।
ধনুষ্টংকার এর চিকিৎসা
১. এই রোগীকে বাড়িতে চিকিৎসা না করে হাসপাতালে স্থানান্তরিত করতে হবে।
২. ক্ষতস্থান ভাল করে পরিষ্কার করতে হবে এবং খোলা রাখতে হবে।
৩. অল্প আলোতে এবং শব্দবিহীন ঘরে রোগীকে রাখা উত্তম ।
৪. মুখে খাওয়ানো বন্ধ রাখতে হবে। তবে শিরার মাধ্যমে বা নাকে নল দিয়ে শিশুর পুষ্টি যোগাতে হবে ।
আরো পড়ুনঃ পেটে ব্যাথার কারণ, লক্ষণ, প্রতিকার
ধনুষ্টংকার এর প্রতিরোধ
১. টিটি বা টিটেনাস টক্সায়েড টিকা নেয়ার মাধ্যমে ধনুষ্টংকার রোগ সহজেই প্রতিরোধ করা যায় ।ধনুষ্টংকার
২. নবজাতকের ধনুষ্টংকার রোধ করার জন্য ১৫ থেকে ৪৫ বছর বয়স্ক সকল মহিলার টিটি টিকা নেয়া উচিত ।
৩. যে সকল মহিলা পূর্বে প্রতিষেধক টিকা গ্রহণ করেন নি তাঁদের যত দ্রুত সম্ভব প্রতিষেধক টিকা নিতে হবে। প্রথম ডোজ নেওয়ার ৪-৬ সপ্তাহ পর দ্বিতীয় ডোজ টিটি টিকা মাংসপেশীতে দেয়া হয়।
৪. গর্ভাবস্থায় ৫ থেকে ৮ মাসের মধ্যে ২ ডোজ টিটি টিকা নিলে মায়ের প্রতিরোধ শক্তি গড়ে উঠে এবং নবজাতকের টিটেনাস হয় না ।ধনুষ্টংকার
৫. দেড় মাস বয়স থেকে গড়ে ১ মাস (৪-৬ সপ্তাহ) পরপর ৩ ডোজ ডিপিটি টিকা দেয়ার মাধ্যমে শিশুকে ধনুষ্টংকার ও আরও ২টি মারাত্মক ব্যাধি থেকে রক্ষা করা যায়।
কোন কারণে ডিপিটি এই সময়ের মধ্যে দেয়া সম্ভব না হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই টিকা দিতে হবে। ১ বছরের মধ্যে টিকাদান সম্পন্ন করতে হবে।
৬. নবজাতকের নাভি কাটার ও বাঁধার জন্য নতুন ব্লেড ও সুতা আধাঘন্টা পানিতে ফুটিয়ে নিতে হবে। নাভিতে কাপড়, ছাই, গোবর ইত্যাদি কোনক্রমেই লাগানো উচিত নয় ।
৭. মহিলাদের ৫টি টিটি টিকা (ইপিআই এর নতুন সিডিউল অনুসারে) দানের মাধ্যমে এ রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ানো যায় ।
এইভাবেই আমরা এই রোগকে প্রতিরোধ করবো। তাছাড়া বাংলাদেশে এখন খুব একটা এই রোগ দেখা যাচ্ছে না। কারণ মানুষ এখন অনেক সচেতন হয়েছে। তারপরও আমরা সচেতন থাকবো। নিচে একটি ভিডিও দেয়া হল যেখান থেকে জেনে নিতে পারবেন ধনুষ্টংকার কেন হয় এবং হলে কী করণীয়-