সুখ আসলে কী তা কে বলতে পারবে? আপনার কাছে যেটা সুখ তা অন্য জনের কাছে তা সুখ মনে নাও হতে পারে। সুখ তাহলে কার কাছে কী?
সুখী আমরা সবাই হতে চাই। আমরা মনে করি, শরীরকে আরাম দিতে পারলে, প্রচুর টাকা থাকলে, আর যা ইচ্ছা হয় তা কিনতে পারলে, যা মন চায় তা খেতে পারলেই হয়তো আমি সুখী।
আসলে কি আমরা যা চাই যেমন চাই তেমন পাওয়াটা বা তেমন হওয়ার নামিই সুখ? একটু সুখ বিষয়টাকে পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যাবে সুখটা আসলে কি? এর আগে একটা গল্প দিয়েই বলা শুরু করি। আমার এক কাজীন।
তার বাবার প্রচুর ধন–সম্পদ। যেমন তার ধন সম্পদ তেমন তার বড় মন তেমনি তার বিলাসী জীবন। বড় মনের মানুষ হওয়ার কারণ
একটাই সে মানুষকে দান করতে খুব ভালবাসে। যখন যাকে মন চায় তাকে টাকা দিয়ে সাহায্য করে । জামা-কাপড়,খাবার-দাবার,বাজার-সদাই যার যা দরকার সে পূরণ করে দিচ্ছে।
কারণ একটাই টাকা খরচ করা দরকার। অনেকেই ব্যাপারটা খুব ভালো এবং প্রশংসার চোখে দেখলেও আমি মোটেও তা দেখি না। কারণ আমি বলি এটা সে অপচয় করছে এবং বাবার কষ্টের সে কোন সম্মান করছে না।
আমার ভাই যদি নিজে কষ্ট করে টাকা উপার্জন করতো কখনো এভাবে দানবীর হাতেমতাই হতেন না। যে টাকা ইনকাম করে সেই জানে টাকা ইনকাম কতটা কষ্টের। তার একটা ভয়ানক স্বপ্ন হলো একদিন সে কানাডার বেগম পাড়ায় বাড়ি করবে। মনে মনে বলি নিজের টাকায় করে দেখ তারপর বল।
আর তার চেয়েও বড় কথা তার দানের পেছনে একটা সুপ্ত বাসনাও আছে,
ভবিষ্যতে সে হতে চায় এলাকার চেয়্যারম্যান। আমি বলি লোক দেখানো দানবীর হাতেম আলী।
আসলে দান করলেই যে কেউ ভাল মানুষ হয়ে যাবে তা কিন্তু নয়।
ভালো–মন্দের ভেদাভেদটা নির্ভর করে এর উদ্দেশ্যের ওপর। তবে আমাদের দেশে নির্বাচনের আগে বুঝতে পারবেন কত ভালো মানুষ আর দানবীর আছে।
নির্বাচন শেষ হলেই সেই মানুষটার অন্য আরেকটা রূপ চোখে পড়বে। আগে যা নিয়েছিলি এখন সুদে–আসলে দ্বিগুণ হারে ফিরিয়ে দে।
মাঝে মাঝে হাসি আর বলি, আমরা ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার চেয়েও সম্ভবত অধম। ভাইয়ের কাজে আমি মোটেও খুশি না, তার অধিকাংশ কাজই আমার কাছে লোক দেখানো মনে হয়। তার মধ্যে দেখানোর একটা ব্যাপার কাজ করে।
এই দেখ আমি এটা দিলাম, ওকে ওটা করে দিলাম, ওর জন্য সেটা কিনলাম এসবই । এই ব্যাপারটা সবাই আরও ভালোভাবে দেখবেন আমাদের মসজিদগুলোতে। হুজুররা বলবে আল্লাহর রাস্তায় দান করুন। তখনই শুরু হবে অমুক সাহেব দশ হাজার, তমুক সাহেব পনের হাজার।
এরপর ধমক সাহেব বললেন, হুজুর লিখেন ত্রিশ হাজার। ব্যাপারটা দান নাকি প্রতিযোগিতা আমার ঠিক বোধগম্য হয়না। আমাদের সমাজের এই ধমক সাহেবরা আবার মসজিদ কমিটির কর্নেল ,লেফটেন্যান্ট । যা অর্ডার করবে তাই কাজে রুপ নিতে হবে।
মহল্লার সাধারণ মানুষ কি বোঝে? আমি যা বলছি তাই হবে, তাই কর । কি চমৎকার! আমি হাঁদারাম দেখি আর হাসি, আর নিজের অন্তরের কথাগুলোকে দিতে হয় ফাঁসি । এই ধমোক সাহেবরা এবার মসজিদের উন্নয়নে কালেকশনে বের হয়েছেন।
ভাই আপনি ৫০০০ দিবেন, হিচকি ভাই আপনি ৭০০০ টাকা দিবেন, কেচকি ভাই বলে না ভাই এত টাকা তো ভাই কঠিন হয়ে যাবে আমার জন্য । ঐ মিয়া যা বলছি তাই, এতে কঠিনের কি আছে মসজিদে দান করবেন। আপনাদের মনে করিয়ে দেই এটা কিন্তু মসজিদের দান সংগ্রহ চলছে।
এবার রাস্তার গাড়ি থামিয়ে কালেকশান চলছে ভাই মসজিদের জন্য দান করে যান। ভাইজান কি আজব টাকা চাওয়ার ভাবমূর্তি, ভাবটা এমন যে না দিলে মনে হয় গলা চেপে ধরবে। এটা কি দান চাওয়া হচ্ছে না চাঁদা আমার বোধগম্য হয় না। সমাজের এমন অভিনব দানের ব্যাপারে বললে বলতেই থাকা হবে।
ভাই আমার ঘুম থেকে উঠে একটা সিগারেট ধরায়। তারপর তার অল্প করে একটু মদ খেতে হয়। আহা কি জীবন! তার একটা গার্লফ্রেন্ড আছে। আবার মন চাইলে গার্লফ্রেন্ড চেঞ্জ হতে খুব বেশি সময় লাগে না।
ভাই বলে সে নাকি পৃথিবীর সেরা সুখী মানুষ। বুঝিনা কিছুই কোনটা সুখ আর কোনটা দুঃখ। আচ্ছা তার এই জীবনকে কি আসলেই সুখ বলে? সুখ কী সেটাইতো বোঝেনা ভাইয়ের মত লোকেরা।
আমি প্রায়ই কিছু লোকের উপদেশ শুনি, শুনি আর হাসি। তাদের কথা হলো তোমাকে এটা জানতে হবে,ঐ টা করতে হবে,জানতে হবে টাকা কামাই।
কিন্তু মাননীয় উপদেশ দাতারা আসলে যা বলছেন তাতে একজন মানুষ যন্ত্র হয়ে যাবে। টাকার জন্য উন্মাদ হয়ে যাবে। আচ্ছা বলুনতো পাঠক, যন্ত্রের কি সুখ বা দুঃখ আছে? এরা জীবনের অপর নাম দিয়েছে টাকা অথবা ক্যারিয়ার। যেখানে সবই আছে ,শুধু মানুষ সুখী হতে চায়। শুধু মানুষ ভুলে গেছে সুখ আসলে কি। সুখী
কিভাবে হতে হয়।
আমার ভাই মদ খায় , গাজা খায়, যখন যা মন চায় তাই করে। আর সে বলে আমি সুখী। আসলেই কি সে সুখী? সমস্যাটা এইখানে যে আমাদের সমাজের অধিকাংশ মানুষ জানে না কোনটা সুখ আর কোনটা অসুখ।
ঘুষ খেয়ে বাড়ি কিনলাম আমি সুখী, গাড়ি কিনলাম আমি সুখী, । আর এক ধরনের মরীচিকার পিছু ছোটা সুখী মানুষ আছে আমাদের সমাজে।
আমার ছেলে বিসিএস ক্যাডার। ফাস্টকেলাস সরকারি চাকরী করে। মা–বাবার খুশি আর গর্বে বুক ভরে যায়। আর এই ছেলেই যখন চাকরিতে ঢুকে চুরি করে ঘুষ খায় তখন মা–বাবা আরো খুশি আমার ছেলে এটা কিনেছে ওটা করছে । হায় রে আল্লাহ একটা চোরের জন্য গর্ব করা।
অবশ্য সেটা সরকার অনুমোদিত পড়াশোনা করা শিক্ষিত জ্ঞানী চোর। শিক্ষিত অফিসার চুরি করলে সেটাকে অবশ্য চোর বলে না বলে বকশিশ, উপহার। এখন আবার ক্লাসিফিকেশন আছে, চাকরি করতে গেলে শুনতে হয়, ছেলে বা মেয়েতো ইংলিশে দুর্বল। না ওর দ্বারা হবে না, ও মেধাবী না ।
আর একজন হয়ত স্বভাবে চোর–বাটপার, আরে তাতে কি? ইংলিশে ভালো, ম্যাথে ভাল , অসাধারণ ছেলে। আসলেই এই অসাধারণই চাকরিতে ঢুকেই শুরু করবে তার আসল রুপ দেখানো। ও যা যা করার করবে তা আরও অসাধারন। এতে অবশ্য কারো কিছু আসে যায় না।
আবার দেশের রুই–কাতলা ঘোষণা দিবে , দেশ থেকে দুর্নীতি দূর করব। হাস্যকর!!! সব মধুসূদনের প্রহসন গুলোর মতই টেস্ট পাই। কারণ আমি তো বেকার বলদ। আচ্ছা ইংলিশ, সাধারণ জ্ঞান এর বাইরে কি একটা মানুষের যোগ্যতার কিছু থাকতে পারে না?
যত জ্ঞান সব ইংলিশ গ্রামারে, বাংলা ব্যাকারনে? আবারো হাসি আর বলি আরে আমিতো বেকার। বলে কি লাভ এইসব কথা। আর আমার মত আকার হীনের কথা কারই বা শোনতে দায় পড়েছে। আসলে আমরা মানুষেরা নিজেদের মত করে সুখের সংজ্ঞা তৈরী করে নিয়েছি।
মন যা চায় সেটাই কি
সুখ? আমরা যে সুখী হতে চাই সেই সুখের নাম দিতে চেয়েছি টাকা, ক্ষমতা, লোক দেখানো সম্মান, এর বাইরে আর মনে হয় ভাবতেও পারিনা। তাই আমরা অসুস্থ হয়েও সুখে থাকি , ভুল পথে হেটে ও সঠিক পথে আছি মনে করি। আসলে আমরা জানিনা কোনটা আমাদের সুখ আর কোনটা আমাদের অসুখ।
দারুন লেখা
অসাধারণ
পোস্ট টা অসম্ভব ভালো লাগলো।