বঙ্গবাজারে আগুন লাগাতে সবার ক্ষতি হলেও আমার লাভই হইছে। আমার দুইটা দোকান ছিল বঙ্গবাজারে। আগুনে পুড়ছে কয়দিন আগে। সবাইত জানেন। আমার কথা গুলা গুছানো হবে না কারণ আমিত লেখক না তবুও কথা গুলা শেয়ার করছি।
খুব ছোট থাকতেই আব্বা মারা গেছিল। আম্মা আর ৩ টা ভাই বোন নিয়ে অনেক কষ্টে দিন কাটাইছি। এক মামা আমারে বংগ বাজার একটা দোকানে কাজ দিল। পড়াশোনা ক্লাস সেভেন শেষ করছিলাম।
ঢাকায় সেই দোকানে থাকি। রাতে আম্মা আর ভাই বোনদের জন্য খুব খারাপ লাগত। সারারাত কান্নাই করতাম, সকালে চোখ ফুইলা থাকতো। দোকানের এক ভাই বলত কিরে নেশা করছস না কি।
আমার মালিক আমারে খুব আদর করত। একটু ভাল লাগতো না। তবু্ও ২ টা হাজার টাকার লাইগা দিন রাত মাল টানতাম। দোকানের যার যা লাগে তা আইনা দেয়া আমার কাজ।
দুপুরে খাওয়ার সময় যে টাকাটা থাকতো মালিকরে ফেরত দিলে মালিক বলতো রাখ তর কাছে। বাজে খরচ করিস না। ভাল কিছু করবি। একটা মাটির ব্যাংক কিনে জমা কইরা রাখতাম।
এইভাবে বেশ অনেক দিন চলে গেল। আস্তে আস্তে আমার সাথে দোকান মালিক, কমচারি সবার সাথে ভাল সম্পর্ক গড়ে উঠলো। এখন খুব ভাল লাগতে শুরু করলো। মালিক আমার বেতন বাড়ায়া দিল। (বঙ্গবাজার আগুন)
তারপর মালিক কে বললাম আমি নিজে দোকান দিব। মালিক আমাকে বললো শোন ব্যবসা তাদেরই ধরা দেয় যাদের ইমান ভালা। ধান্দার চিন্তা করবি না। দুই টেকা কম আর বেশি একদিন বড় ব্যবসায়ী হইতে পারবি।
আম্মার কাছ থেকে বাড়ি থেকে অনুমতি নিয়ে আগের মাসের বেতন, ব্যাংকের জমানো টাকা, আর মালিক দিছিল ৭ হাজার টাকা।
এই দিয়েই শুরু করলাম আমার ব্যবাসা। বংগ মারকেট এর পিছনের গলিতে কয়টা রুমাল, গেঞ্জি, বাচ্চাদের কাপড় নিয়ে বসে থাকি। (বঙ্গবাজার আগুনের খবর)
আমার বাজার কমিটির সবার সাথে খুব ভাল সম্পর্ক ছিল। সভাপতি কাকুকে বলতেই কাকু বলে টাকা লাগলে আমারে জানাইস। আর মানুষ এইভাবেই বড় হয়।
আস্তে আস্তে পড়ে আমি দোকান নিলাম বংগ মারকেটের ভেতরে। বোনটাকে বিয়ে দিলাম খুব ভাল ঘরে। ভাই একটাকে বিদেশ পাঠায়া দিলাম। আর আমার যতদূর মনে পড়ে আমি বড় দোকান নেয়ার পর আমার কোন আত্মিয় সজন এর কাপড় খুব একটা কিনতে হয় নি।
চাচাত ভাই একটাকে মেডিকেলে ভর্তি করলাম। চাচাত বোন এর বিয়ে। পাড়াপ্রতিবেশির সমস্যা। আরও আরও আরও কত কি। আর আল্লাহ আমরে দিতেও থাকলো। সবাইকে তোলার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকলাম যেন সবাই মিলে ভাল থাকতে পারি। (বঙ্গবাজার আগুনে শোকাহত)
যতবার বড় বড় রিস্ক নিছি আল্লাহ আমারে সহায় করছে। আর আমার মার দোয়াত আছেই। আমি বিয়ে করলাম। বাচ্চা হল। আম্মাকে ঢাকা নিয়ে আসলাম। এর মাঝে আমার বড় দোকান হয়ে গেল ২ টা।
এমপোট এর একটা লিংক ও পেয়ে গেলাম। কেউ যদি আমায় বলে আমার ব্যবসার উন্নতির কারন কি- তাহলে আমি বলবো কাস্টমার এর সাথে ব্যবহার। আমি এমনো হইছে লস দিয়া কাপড় সেল দিছি। পড়ে সেই কাস্টমার আমারে এমন ব্যবসা দিসে যে তার টাকা দিয়া আমার ২/৩ মাস চলা গেছে।
একদিনের ব্যবহার দিয়া এমনো হইছে আমি ১০ লাখ টাকা নিছি কোন স্টাম্প সই ছাড়া। খালি ব্যবহার আর বিশ্বাস। আমি মানুষের সাথে মিশতে পারি তাদের মত করে আর এইটাই আমার বড় তেলেছমাতি।
আমি আগে বুঝি এই লোকটা কেমন, তার উদ্দেশ্য কি, কি চায় সে। তারপর তার লগে সেইভাবে সম্পর্ক তৈরি করি। আর আমি যে কোন জিনিসেই সবুর করি আর শেষ অব্দি চেষ্টা করি।
আমার শশুর বাড়ি ঢাকা হওয়ায় যা হইছে এই পরিবারের সবই আমাকে দেখতে হয়। শশুরের ছেলে ছোট, আর আমি বড় মেয়ের জামাই। তাহলে বুঝেন এখন অবস্থা।
যাক সেসব কথা। আগুন লাগার আগের দিন। হামিদুল কইলো ওস্তাদ আমার জানি কেমন লাগতাছে। আপনি কই যাইতাছেন। আজকে আর যায়েন না। আমি যশোর গেলাম এর আগের দিন। তখন যশোর থাইকা আইতাছি।
আলম আমাকে ফোন দিয়া কইলো বস আগুন লাগছে।
কিছিক্ষন পর হামিদুল ফোন দিল বললো ওস্তাদ আমরাত শেষ হইয়া গেলাম। আমাদের সবশেষ। এর মাঝেই নানান জন ফোন দিতে থাকলো। আমি ঢাকা আইসা দেখতে থাকলাম চোখের সামনে সব পুড়তাছে।
আমার শরীলে শক্তি পাচ্ছিলাম না। মাথাটা কেমন ঘুড়ে গেল। পড়ে আর কিছু বলতে পারি না। যখন চোখ খুললাম দেখি আম্মা আমার পাশে।
আমাদের সব শেষ হয়া গেল বলে আমি আম্মাকে জড়ায়া ধরলাম। আম্মা শুধু বলছে আল্লাহ দিছে, আল্লাই নিছে, আল্লাহ আবার দিবে। আমার মা কি যে শক্ত মহিলা তা বলার নেই।
পরিচিত অনেকেই ফোন দিচ্ছে আবার অনেকে দিচ্ছে না। আমি দুই দিন বিছানা থেকে উঠতে পারছি না। এর মাঝে আমার শালা বিদেশ যাবে তার ফ্লাইট। আমার বউ বললো সাগর এর কাল ফ্লাইট ওর টাকাটা যে লাগে। আমি রীতিমতো আসমান থেকে পড়ছি। আমি শেষ হয়ে গেলাম কিন্তু শালাকে টাকাটা দিতে হল। (বঙ্গবাজার আগুনের ছবি)
কি করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। এর মাঝে যাদের কাছ থেকে বাকি নিছি তারাও তাগদা শুরু করলো। আমার হাতে যা ছিল তা মুটামুটি সবটাই ইনভেস্ট করছিলাম। ভাবছি এইবারের ইদে বড় একটা দান মারবো। আসলে বড় দানই মারছি যে কারণে আজ প্রায় নিঃশ।
আবার ঘুরে দাড়ানোর জন্য চেষ্টা করতে শুরু করলাম। প্রথমেই যেটা বিদেশে থাকে ওরে বললাম লাখ দশেক টাকা দেয়ার জন্য। ও বলে ভাই এত টাকাত এখন নাই। আমি তরে ৫০০০০ টাকা দিচ্ছি।
কথাটা শুনে আমি বুবা হয়ে গেলাম। এরপর ছোট বোন জামাই, দুলাভাই ( বউ এর চাচাত বড় বোনের জামাই), বন্ধু, এক কথায় কাছের বলতে যারা ছিল। সবার কাছেই টাকা চেয়ে দেখলাম আসল দুনিয়া।
কেউ আমাকে ২০০০০, ১০০০০ টাকা দিতে চাইলো।কেউএক সপ্তাহ আগে বাড়ি কিনছে। কেউ জমি কিনছে। আবার কেউ বলে ভাই আর কয়টা দিন আগে হইলেই আর সমস্যা ছিল না।
দিশেহারা হয়ে গেলাম। সারারাত সজাগ থাকি, এক মিনিটো ঘুম নাই। এর মাঝে দোকানের ছেলে- পেলে গুলা কেউ বাড়িতে, আবার কেঊ অন্য জায়গায় কাজ নিল।
আরো পড়ুনঃ
আমি আম্মার রুমে গিয়ে দেখি আম্মা নামাজে বসে হাউমাউ কাদছে। বের হয়ে আসলাম বাসা থেকে। বাইরে এসে রফিকের দোকানে বসলাম। রফিক বলে ভাই আপনার চা, চা খাচ্ছি, আর একটা সিগারেট ধরালাম। (বঙ্গবাজার আগুন)
আমার ব্যবসা শেষ হয়ে গেছে কষ্ট নাই। কিন্তু যাদের জন্য আমি এত কিছু করলাম আজ আমার এই বিপদের দিনে কেউ আমারে ১০/২০ হাজার টাকা দিয়া সাহায্য করবে। এই ভিক্ষাটা আমি নিতে পারি নাই।
হামিদুল আইসা কইলো ওস্তাদ আপনি এইখানে, বাসায় গেছিলাম আপনারে পাই নাই। কিরে তুই বাড়ি গেলি না। আমি নিউমার্কেট হযরত ভাইরে ফোন দিয়া দিমুনে কালকে থাইকা হযরত ভাইয়ের দোকানে কাজ করিস।
হামিদুল পকেট থাইকা একটা প্যাকেট বের করছে। আমার হাতে দিয়া কইলো ওস্তাদ আমরারত বাইচ্চা থাকতে হইবো।
আমার কাছে ২১ হাজার টাকা ছিল, আর আপনি যে সাইকেলটা দিছিলেন সেইটা বেইচ্চা দিছি কাল আরও ৫ হাজার টাকা পামু। ওস্তাদ চলেন আবার শুরু করি। আমরার বাচতে হইবো ওস্তাদ।
প্যাকেটটা খুইলা দেখি ছিড়া দুই টাকা, পাচ টাকা, দশ টাকা। আহারে আমিত জানি জমানো টাকা কতটা মূল্যবান। আমার ভাই তার এক কাটা জমি বিক্রি কইরা দিতে পারলো না।
ছোট বোন জামাই টা ভয়ে ফোনই দেয় না যদি টাকা চাই। আর এই হামিদুলরে কত গাল্লাইছি, কত তুই তুক্কারি করছি আর সেই আইজ আমার বিপদের দিনে তার সবটা দিয়ে সাহায্য করতে আসলো।
আর আমি যাদেরকে এতটা সম্মান করছি, আসলেই ভাল হোটেলে খাওয়াইছি, কি আদর আপ্যায়ন করছি। আজ তার কই। আমিত আজ রাস্তার ফকির তাই ওরা আমারে ভিক্ষা দেয়। ওই ১৪-১৫ বছরের ছেলেটা যেটা পারলো আমার এতগুলা আপনজন তারা কেউ পারলো না। (বঙ্গবাজার আগুনের খবর)
ও আল্লাহ। হাউমাউ কাইন্দা দিয়া হামিদুলরে জড়ায়া ধরলাম। ওস্তাদ আমার আম্মারে কইছি গতবার যে চেইডা বানায়া দিছিলাম সেইটা বেইচা দিয়া দোকানের জন্য টাকাদিব। ওস্তাদ আপনি শক্ত হন। আমাদের বাইচ্চা থাকতে হইবো।
দোকানের অন্যরাও কান্না করছিল। মনে মনে ঠিক করলাম হামিদুলরে নিয়া আবার শুরু করবো। এখন আমার আপনজন অনেক কম তাই আশা করি অল্প দিনেই ঘুরে দাড়াবো। কারণ আমাদের বাইচ্চা থাকতে হইবো।