ঘাসের ডগায় চিকচিক করছে শিশির কনা। সূর্যের আলোর পরশে শিশির কনা হীরার মতো দূতী ছড়াচ্ছে আর জানান দিচ্ছে শীতের আগমনী বার্তা। গাছীরা ব্যস্ত সময় পার করছে খেজুর রস সংগ্রহে, বাড়ির মা চাচীরা ব্যস্ত নানান স্বাদের পিঠা তৈরিতে। শীত যেন এক মধুর আয়োজনের উন্মাদনা নিয়ে হাজির হয়েছে। মিঠে রোদ গায়ে মাখছেন বাড়ির প্রৌড়জন। ঘর থেকে ভেসে আসছে দারাজ কন্ঠের পবিত্র কুরআনের বাণী। মনকে প্রসন্ন করে সেই সুমধুর সুর।
কিন্তু এই শীতের সাথে ফ্রি ফ্রি পাওয়া যায় নানা ধরণের কিছু অস্বস্তি। যা অনেকেরই কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বেশিরভাগ দেখা যায় শীতের আগ্রাসী ধাওয়ায় শিকার হয় বাড়ির বৃদ্ধ ও শিশুরা। বড়রা যে হয়না তা কিন্তু নয়। যে কষ্টগুলো নিয়ে শীত হাজির হয় তার মধ্যে ঠোঁট ও পা ফাটা অন্যতম। আর আজকের আলোচনা ঠোঁট ও পা ফাটা নিয়ে। ঠোঁট ও পা ফাটা অত্যন্ত অস্বস্তিকর ও যন্ত্রণাদায়কও বটে।
ঠোঁট ও পা ফাটা এর কারণ কি, কেন এমন হয়?
প্রথমেই জানবো শীতে ঠোঁট, পা ও চামড়া ফাটার বৈজ্ঞানিক কারণ। আমাদের ত্বকে সিবেসিয়াস (sebaceous glands) গ্রন্থি নামক অণুবীক্ষণিক গ্রন্থি রয়েছে। যা থেকে এক প্রকার তেল জাতীয় পদার্থ মেদ বা মোমের মতো রস ক্ষরিত হয়। এর নাম সিবাম(sebum)। আর এটি আমাদের ঘামের সাথে বের হয়।
সিবাম ঘামের সাথে মিশে চামড়ায় ছড়িয়ে পড়ে এবং আমাদের ত্বককে আর্দ্র রাখে। এর ফলে চামড়া ফাটে না। কিন্তু শীতকালে বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ অনেক কমে যায়। আর শীতকালে আমাদের ঘামও হয় না। এর ফলে যা ঘটে তা হল সিবাম গ্রন্থি থেকে বেরিয়ে তেলতেলে পদার্থ শরীরের চামড়ায় ঠিকমতো ছড়িয়ে পড়তে পারেনা। তখন শরীরের শুকনো জায়গায় গুলো কুঁচকে গিয়ে ফেটে যায়। (ঠোঁট ও পা ফাটা)
এছাড়া অতিরিক্ত ঠান্ডা থেকেও এক ধরনের যন্ত্রণার সৃষ্টি হতে পারে। ঠোঁটে ফুসকরির মত উঠতে দেখা যেতে পারে। তারপর এগুলো শক্ত হয়ে যায়। দেখে মনে হবে ঠোঁটের ওই অংশে সর পড়েছে। প্রায় ১০-১৫ দিন থাকার পর অবশ্য তা ঝরে যায়। এটি সাধারণত শীতের শেষের দিকে এবং বসন্তের প্রথম দিকে দেখা যায়।
ঠোঁট ফাটার কারণ:
- বাতাসে আর্দ্রতা কমে যাওয়ার ফলে ঠোঁট ফেটে যায়।
- কড়া সূর্যের আলোয় বেশিক্ষন থাকলেও ঠোঁট ফেটে যেতে পারে।
- এলার্জি, থাইরয়েডের সমস্যা এবং শরীরের ভিটামিন বি কমপ্লেক্সের অভাবেও ঠোঁট ফেটে যেতে পারে।
- জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট চাটা , ঠোঁট কামরানোর মত অভ্যাস থাকলেও ঠোঁট ফেটে যেতে পারে। আবার সাইট্রাস জাতীয়
ফল খেলেও ঠোঁট ফেটে যায়।
মানুষের মুখের অন্যতম সৌন্দর্য অংশ হলো ঠোঁট। বিভিন্ন মানুষের ঠোঁটের ধরন বিভিন্ন হয়ে থাকে যেহেতু ঠোঁট মানুষের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ তাই এর যত্নের দিকেও বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। ত্বকের চেয়ে ঠোঁট বেশি নরম হয়। তাই এর যত্ন নিতে হয়। তাহলে চলুন দেখে নেই কিভাবে প্রাকৃতিক উপায়ে ঠোটের যত্ন নিতে হয়। (ঠোঁট ও পা ফাটা)
১. সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধোয়ার পর ভেজা ঠোঁট নরম কাপড় দিয়ে হালকা করে ঘষে পরিষ্কার করুন। এতে ঠোঁটের মরা কোষ দূর হবে।
২. রাতে শোয়ার সময় সামান্য আমন্ড অয়েল ঠোঁটে ব্যবহার করুন ভালো ফল পাবেন।
৩. প্রচুর পানি পান করুন। পানির অভাবে ঠোঁট ফাটে তাই পানির বিকল্প নেই।
৪ লেবুর রস ও চিনি মিশিয়ে মেসেজ করুন। লেবুর রস ব্যবহার এর ফলে সামান্য জ্বালা করতে পারে কিন্তু কিছুক্ষণের মাঝে ঠিক হয়ে যাবে।
৫. নারকেল তেল বা অলিভ অয়েল ব্যবহার করা যেতে পারে।
৬. দ্রুত ঠোঁটফাটা থেকে মুক্তি পেতে চাইলে মধু ও গোলাপজলের বিকল্প নেই। এক চামচ মধু ও এক চামচ গোলাপ জল নিয়ে মিশ্রণ তৈরি করুন। তারপর ঠোঁটে ব্যবহার করুন ১৫ মিনিট এর জন্য। ১৫ মিনিট পর ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ঠোঁট ধুয়ে ফেলুন। দিনে কমপক্ষে
চারবার মিশ্রণটি ব্যবহার করুন ভালো ফল পাবেন।
আরো পড়ুনঃ
৭. জোজোবা অয়েল:
জোজোবা ওয়েল ঠোঁটফাটা কমাতে বেশ উপযোগী। দিনে দুবার এটি ঠোঁটে ব্যবহার করুন। ১৪ মিনিট পর ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। ঠোঁট ফাটা কমবে এবং ঠোঁটে লালচে আভা ফিরে আসবে।
৮. গ্রিন টি ব্যাগ:
গ্রিন টি ব্যাগ খুবই ভালো মাস্চারাইজার। গ্রিণ টি ব্যাগে ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরুন এবং ৪-৫ মিনিট অপেক্ষা করুন, পরবর্তীতে ফেলে দিন। এটি দিনে একবার করুন। (ঠোঁট ও পা ফাটা)
৯. মিল্ক ক্রিম:
তাজা দুধের সর বা মিল ক্রিম ঠোঁটে লাগান এবং ১৫ মিনিট লাগিয়ে রাখুন। এরপর হালকা গরম পানি দিয়ে ঠোঁট ধুয়ে ফেলুন। এটি অত্যন্ত কার্যকরী।
১০. এলোভেরা :
টাটকা এলোভেরা জেল ঠোঁটে ব্যবহার করুন। এটি প্রাকৃতিক মাস্চারাইজার এর কাজ করবে। তাছাড়া ব্যথা দূর করতে কার্যকর ভূমিকা রাখে। কালো দাগ দূর করতে এর কোন বিকল্প নেই। (ঠোঁট ও পা ফাটা)
১১. শশা:
একটুকুরো শশা নিয়ে ঠোঁটের উপর হালকা করে ঘষে নিন। ১৫ মিনিট পর পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। যতবার খুশি ততবার ব্যবহার করতে পারেন তাতে কোন সমস্যা নেই।
১২. গ্লিসারিন:
সকালে ও রাতে ঠোঁটের যত্নে গ্লিসারিন ব্যবহার করুন। তবে গ্লিসারিনের সাথে সমপরিমাণ পানি মিশিয়ে নিতে হবে। (ঠোঁট ও পা ফাটা)
পা ফাটায় করণীয় :
শীতের সময় অনেকেরই পা ফাটে। এছাড়া অনেকের আবার বারোমাসি পা ফাটা থাকে। ফাটাফা দেখতে কুৎসিত মনে হয়। যাদের শীতে পা ফাটে তারা শীত শুরু হওয়ার আগেই পায়ের যত্ন শুরু করবেন। কুসুম গরম পানিতে বেশি করে লবণ ফেলে তার মধ্যে পা ১০-১৫ মিনিট ডুবিয়ে রাখুন।
এরপর পা ঘষে ঘষে ফাটা জায়গা পরিষ্কার করে ভালোভাবে তোয়ালে দিয়ে মুছে শুকিয়ে নেন। এরপর কোন লোশন কিংবা গ্লিসারিনের সাথে সমপরিমাণ গোলাপজল কিংবা নরমাল পানি মিশিয়ে প্রতিদিন রাতে মেসেজ করবে। খাবারের প্রতিদিন ভিটামিন এ ভিটামিন ভিটামিন সি রাখবেন। শীতের সময় প্রচুর কাঁচা গাজর খাবেন। ক্যালসিয়াম যুক্ত খাবার খাবে। কচু শাকে প্রচুর ক্যালসিয়াম রয়েছে। থেকে নিয়মিত পায়ের যত্ন নিলে পা ফাটবে না।
শীতে ঠোঁট ফাটার মতো পায়ের গোড়ালি ফাটার ভোগান্তিও কম নয়। আর পা ফাটা যেমন অস্বস্তিকর তেমনি কষ্টদায়কও বটে। এ সময় হাঁটাচলা করা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। হাটার সময় পায়ে ধুলো ময়লা জমে আরো মারাত্মক আকার ধারণ করে।
তখন তা থেকে বাঁচার জন্য অনেকে বাজারের নানা ক্রিম ব্যবহার করে। (ঠোঁট ও পা ফাটা)
বাজারে নানা প্রকার রাসায়নিক মিশ্রিত ক্রিমের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও নেহায়েত কম নয়। তাই পা ফাটা থেকে বাঁচতে উল্টাপাল্টা কোন ক্রিম ব্যবহার না করে ঘরুয়া উপায়ে ভাল হওয়া যায়। তাই এখন আলোচনা করা যাক পা ফাটা থেকে মুক্তি পেতে কি কি ঘরোয়া উপায় মেনে চলা যেতে পারে।
পড়ুন:
১. গ্লিসারিন ও গোলাপজলের ফুট মাস্ক:
উপকরণ: এই ফুট মাস্ক তৈরির জন্য আপনার যা প্রয়োজন হবে তা হলো। লেবুর রস, গ্লিসারিন, গোলাপজল, লবণ এবং সামান্য উষ্ণ গরম পানি। (ঠোঁট ও পা ফাটা)
পদ্ধতি: একটি বড় পাত্রে কুসুম গরম পানি নিন। তাতে এক চা চামচ লবণ একটি লেবুর রস এবং এক কাপ গোলাপজল
নিয়ে ভালোভাবে মিশ্রণ তৈরি করুন। এবার এই মিশ্রণে ১৫ থেকে ২০ মিনিট পা ভিজিয়ে রাখুন। মাজনী, ঝামার মত শক্ত কিছুর সাহায্যে পায়ের ফাটা ও মরা চামড়া তুলে পা ধুয়ে ফেলুন।
এরপর এক চামচ গ্লিসারিন ও এক চামচ লেবুর রস এবং এক চামচ গোলাপ জল মিশিয়ে একটি মিশ্রণ তৈরি করুন। মিশ্রণটি রাতে ব্যবহার করবেন। এটি সপ্তাহে দুই থেকে তিনবার ব্যবহার করবেন। খুব দ্রুত পা ফাটার সমাধান পাবেন ইনশা্ল্লাহ।
২. নারকেল ও কলার ফুট মাস্ক:
পা ফাটার সমস্যা মারাত্মক পর্যায়ে চলে গেলে এই ফুট মাস্কটি ব্যবহার করতে পারেন। এটি খুবই কার্যকর।
উপকরণঃ কলা টুকরো করে কাটা এবং একই রকম করে কিছু নারকেলের টুকরো। তিন থেকে চার টুকরো হলেই হবে।
পদ্ধতিঃ একটি কলা এবং তিন চার পিস নারকেল একসাথে ব্লেন্ড করা অথবা পাটায় পিশে নিন। টাটকা নারকেল হলে ভালো। এবার এই মিশ্রণটি পায়ের যে অংশে ফাটা সে স্থানে ভালোভাবে লাগিয়ে নিন। যখন এটি শুকিয়ে যাবে তখন উষ্ণ গরম পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। যদি তাজা নারকেল না পাওয়া যায় তবে একটি কলার সাথে নারকেল তেল দুই তিন চা ২/৩ চা চামচ মিশিয়ে নিলেও হবে।
৩. চাল বাটাও তেলঃ
পা ফাটা আরেকটি কার্যকরী উপাদানহলো এই স্ক্রাবারটি। এটি প্রতিদিন ব্যবহার করলে খুব দ্রুত ফল পাওয়া যায়। ঘরোয়া উপকরণে
খুব সহজেই এটি তৈরি করা যায়। (ঠোঁট ও পা ফাটা)
উপকরণঃ দুই তিন চার চামচ চাল। অলিভ অয়েল, মধু ও ভিনেগার(সাদা)।
পদ্ধতিঃ চাল ভিজিয়ে বেটে নিতে হবে। কিছুটা দানাদার করে বাটতে হবে। এর সাথে তিন চামচ ভিনেগার এবং দুই চামচ মধু দিয়ে ঘন পেস্ট তৈরি করুন। এবার উষ্ণ গরম পানিতে পা ডুবিয়ে রাখুন ১৫ থেকে ২০ মিনিট। ভেজা পায়ে এই পেস্টটি ভালোভাবে লাগিয়ে রাখুন। সপ্তাহে দুই তিনবার এটি ব্যবহার করতে পারবেন।
প্রতিদিন ভালোভাবে পা ধুয়ে শুকনো করে মুছে গ্লিসারিন সমপরিমাণ পানির সাথে মিশিয়ে পায়ে মালিশ করুন।
এতে পায়ের ত্বক নরম থাকে এবং পা ফাটা রোধ হয়। (ঠোঁট ও পা ফাটা)
সবশেষ কথা হলো শীততো চলেই এসেছে। তাই এই শীতে ঠোঁট বা পা ফাটা থেকে বাঁচতে হলে সবার আগে যেটি প্রয়োজন তা হলো নিজের সচেতনতা। আমরা হয়ত অনেকেই জানি কিভাবে পা বা ঠোঁট ফাটা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। কিন্তু নিজেদের অলসতা আর অবহেলার জন্য আমরা এই সব সমস্যা থেকে বাঁচতে পারি না। তাই প্রাকৃতিক বা ঘরোয়া উপায় ব্যবহার করে কিভাবে নিজের সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায় তার অভ্যাস গড়ে তুলি। (ঠোঁট ও পা ফাটা)