জনগন এর জান-মাল
নিরাপত্তার জন্য সারা পৃথিবীতে পুলিশ বাহিনীর প্রচলন নতুন কিছু নয়। পুলিশে কাজ করা
একদিকে যেমন সম্মানের অন্যদিকে মানুষের সেবা করার মাধ্যমে নিজের জীবনকে ধন্য করা। পুলিশ
নিয়ে তাই নানা মানুষের নানা কৌতুহল এর অভাব নেই। আর পুলিশের সকল কার্যক্রম পরিচালিত
হয় থানা থেকে।
সেজন্য পুলিশ
বাহিনীর বিভিন্ন বিষয় ধারাবাহিক ভাবে আমরা আলোচনা করলেও আজকে আমরা জানবো- কোতয়ালী থানা
ও মডেল থানার পার্থক্য। এর পূর্বে আমাদের জানা
প্রয়োজন থানা কি এবং এর ইতিহাস। চলুন তাহলে প্রথমেই জেনে নেই থানার ইতিহাস।
থানার ইতিহাস
থানা পুলিশ
বাহিনীর প্রশাসনিক ইউনিট। ১৭৯২ সালে ৭ই নভেম্বর বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি সরকার কর্তৃক জারিকৃত
হয় একটি প্রবিধান। সেখানে বলা হয় জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের তাদের নিজ নিজ জেলাকে প্রয়োজন
অনুযায়ী কয়েকটি পুলিশী এক্তিয়ারভুক্ত এলাকায় বিভক্ত করা। এই পলিসি এখতিয়ার ভুক্ত
এলাকাকে থানা বলা হয়।
একটি থানার
সর্বোচ্চ পরিধি ১০ বর্গ ক্রোশ নির্ধারিত করা হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে থানাকে সম্পূর্ণরূপে
পুলিশি এখতিয়ারভুক্ত অঞ্চল কে বোঝানো হতো। আর এই থানার দায়িত্বে থাকতেন একজন অফিসার
ইনচার্জ বা ওসি। তিনি পদবী বলে
একজন অধস্তন পুলিশ কর্মকর্তা।
১৯৬১ সালে সার্কেল ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে থানা হয়ে
ওঠে উন্নয়ন কর্মকান্ডের প্রধান কেন্দ্র। প্রাদেশিক সরকারের উন্নয়ন বিষয়ক কর্মকান্ডের
জন্য সকল বিভাগ থানার অধীনেন্যাস্ত হয়। সে সময় থানা পর্যায়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী
নিয়োগ করা হতো। এটি অব্যাহত থাকে ১৯৮২ সালের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত।
১৯৮২ সালে এরশাদ সরকার ক্ষমতা লাভের পর প্রশাসনিক সংস্কার
ও পুনর্গঠন কমিটির সুপারিশ ক্রমে প্রশাসনিক ইউনিট হিসেবে মহকুমা বিলুপ্ত করা হয়। ১৯৮২
সালের পর থানাকে উপজেলায় উন্নীত করা হয়। উপজেলার প্রধান কর্মকর্তা হন উপজেলা নির্বাহী
অফিসার।
কিন্তু ১৯৯২ সালে আবার উপজেলা ব্যবস্থা বাতিল ঘোষণা করা
হয় এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসার পদটি থানা নির্বাহী অফিসার পদে উন্নীত করা। উপজেলা
ব্যবস্থা জারিকৃত ইন্সপেক্টর পদে উন্নীত করা হয়। কিন্তু ১৯৯৯ সালে আবারো উপজেলা ব্যবস্থা
চালু করা হয়।
বর্তমানে বাংলাদেশে মোট থানার সংখ্যা ৬৫২টি। ২০২১ সালের
নতুন দুটি থানা উদ্বোধন করা হয়। উনিশে জানুয়ারি
৬৫১ তম হিসেবে নোয়াখালী জেলার ভাসান চর থানা এবং ২০ শে জানুয়ারি ৬৫২ তম কক্সবাজার
জেলার ঈদগাঁও থানা।
থানার কথা বললেই, যে কথাটা সর্বাগ্রে মনে হয় তা হল পুলিশ।
চলুন তাহলে জেনে নেই বিশ্বে প্রথম কিভাবে পুলিশের আবির্ভাব হয়।
আরো পড়ুনঃ
পুলিশের
ইতিহাস
খ্রিস্টের জন্মের বহু বছর আগে থেকে পৃথিবীতে পুলিশের
প্রচলন ছিল। ইতিহাস থেকে জানা যায় প্রাচীন সৈনিক সভ্যতায় পার্ফক্টাস নামক একটি বাহিনী
ছিল। এই বাহিনীর প্রধান কাজ ছিল শাসকের নিরাপত্তা দান এবং সাম্রাজ্যের আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা
ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা।
এই বাহিনী বিভিন্ন সেক্টরের দায়িত্ব পালন করত। মজার
বিষয় হচ্ছে সেই সময়ও পার্ফক্টাসদের
মধ্যে নারীও ছিল।
অন্যদিকে প্রাচীন গ্রিসের দাসদের নিয়ে একটি বাহিনী গঠন
করা হয়েছিল। তাদের কাজ ছিল পুলিশিং। ইরানের ৩০০ দাসদের নিয়ে এই বাহিনীর গঠন করা হয়েছিল।
এরা ছিল রড বেয়ারার বা লাঠি বহনকারী। এদের কাজ অনেকটা বর্তমান পুলিশের মতোই ছিল।
আগস্টাসের রোমান সাম্রাজ্যেও পুলিশ বাহিনী ছিল। তাদের
নাম ছিল ভিজিল। মধ্যযুগেও দেখা যায় পুলিশ ব্যবস্থার আধিক্য। তখন নানান নামে ও নানান
রুপে পুলিশ ব্যবস্থা দেখা যায়।
সে সময় স্পেনেও নিজস্ব পুলিশ ব্যবস্থার প্রচলন ছিল।
এরা ছিল সশস্ত্র। মূলত শান্তিরক্ষা বাহিনী হিসেবে এরা কাজ করতো। এদের বলা হত হলি ব্রাদারহুড।
ফ্রান্সেও তখন পুলিশের আবির্ভাব হয়। তাদের বলা হত মার্শাল।
নরমেন সাম্রাজ্যের পুলিশকে বলা হতো সেরিফ।
আধুনিক পুলিশের যাত্রা
কিং লুইস এর সরকার ১৬৬৭ সালে সর্বপ্রথম সুগঠিত পুলিশ
বাহিনী গড়ে তোলেন। এটি গঠিত হয় ফ্রান্সের প্যারিসে। আর এর মাধ্যমে আধুনিক পুলিশ বাহিনীর
যাত্রা শুরু হয়।
ফরাসি বিপ্লবের সূচনা লগ্নে নেপোলিয়ান ১৭ই ফেব্রুয়ারি
১৮০০ সালে প্যারিসের পুলিশ বাহিনী পুনরায় সংগঠিত করেন। পরবর্তীতে ১২ই মার্চ ১৮২৯ সালে
প্রথম পোষাকধারী পুলিশের আবির্ভাব ঘটে। তাদের বলা হতো সিটি সার্জেন্ট।
এভাবেই ধীরে ধীরে আবির্ভাব হয় আধুনিক পুলিশের।
ভারত উপমহাদেশে প্রথম পুলিশ ব্যবস্থা
ব্রিটিশ শাসনামলের লর্ড ক্যানিং সর্বপ্রথম ভারত উপমহাদেশে
পুলিশ ব্যবস্থা চালু করেন। ১৮৬১ সালে ভারতীয় পুলিশ আইন পাস হয়। এর মাধ্যমে লর্ড ক্যানিং
ভারত উপমহাদেশে প্রথম পুলিশ ব্যবস্থা চালু করেন।
বাংলাদেশের প্রথম পুলিশ ব্যবস্থার সূচনা।
প্রাচীন বাংলায় পুলিশ ব্যবস্থা না থাকলেও প্রশাসনিক
ব্যবস্থার কথা জানা যায়। মোগল যুগে
এর উন্নতি সাধিত হয়। মোগল সম্রাট আকবর প্রশাসনিক কর্মকান্ড, আইন প্রয়োগ এবং রাজ্যের
শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কোতোয়াল বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে ব্রিটিশ শাসন আমলে
উপমহাদেশে লর্ড ক্যানিং প্রথম পুলিশ
ব্যবস্থা চালু করেন। যা পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে। ব্রিটিশ শাসক বিলুপ্তির পর ১৯৪৭
সালের বাংলাদেশের পুলিশকে বলা হতো ইস্টবেঙ্গল পুলিশ।
দেশভাগের পর নাম পরিবর্তন করে
রাখা হয় ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ। দেশে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এই পাকিস্তান পুলিশের
অবদান অনস্বীকার্য। পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে তারাই সর্বপ্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ
গড়ে তোলে। রাজার বাগ পুলিশ লাইন থেকে সর্বপ্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে তারা।
মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর এই পুলিশ
বাহিনীর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাংলাদেশ পুলিশ।
এখন মূল আলোচনায় আসা যাক। আমাদের আলোচ্য বিষয় ছিল কোতোয়ালি
থানা এবং মডেল থানা কি? তাহলে চলুন আমরা দেখে নেই কোতোয়ালি থানা এবং মডেল থানা কি?
এর পার্থক্য কি?
আরো পড়ুনঃ
কোতোয়ালি থানা
বাংলা একাডেমীর অভিধানে কোতোয়াল শব্দের অর্থ বলা হয়েছে
নগর রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত আধিকারিক,কোটাল বা কমিশনার। অনুসন্ধানের মাধ্যমে জানা
যায় নগর বা বন্দরের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে যিনি প্রধান তাকে কোতোয়াল বলা হয়।
ব্রিটিশ আমলে উপমহাদেশের জমিদারি,কৃষি, হাট বাজারের ইদারা, বন্দর, ইজারা থেকে রাজস্ব
উত্তোলন করত।
এ সময় রাজস্ব
সংগ্রহের জন্য নিয়মিত পুলিশ বাহিনী ছিল। শুধু তাই নয় দাঙ্গা পুলিশের মত কোতোয়াল
বাহিনী অনেক অনেক থানায় দায়িত্ব পালন করত। সে সময় কোতোয়ালি ছিল সেই থানার প্রধান।
তার অধীনস্ত ছিল দারোগা, জমাদার, হাবিলদার, নায়েক, কনস্টেবল ইত্যাদি।
যারা খাজনা দিতে পারতো না তাদের ধরে এনে থানায় বন্দি
রাখত। পরবর্তী সময়ে এই থানাগুলোই কোতোয়ালি থানা হিসেবে পরিচিতি পায়। সেই কারণেই
এখনো দেশের পুরনো শহর বা বিভাগীয় শহর বা জেলাগুলোতে কোতোয়ালি থানা দেখতে পাওয়া যায়।
এর নাম এখনো অপরিবর্তিত রয়ে গেছে।
আমরা যাকে বর্তমানে ওসি হিসেবে জানি তিনি মূলত কোতোয়াল।
সে সময় থেকেই এই কোতোয়ালি থানার বিষয়টি এসেছে।
কোতোয়ালের দায়িত্ব
আবুল ফজল এর আইনে আকবরী গ্রন্থের মাধ্যমে জানা যায়,
কোতোয়ালের দায়িত্বের পরিধি ছিল ব্যাপক। তার দায়িত্বের মাঝে ছিল নগরবাসী নিরাপত্তা,
সান্ধ্য আইন আরোপ, নগরের বাড়িঘর ও সড়কের তথ্য সংগ্রহ
ও সংরক্ষণ। প্রয়োজন অনুযায়ী বাড়ির বাসিন্দাদের তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ।
নগরবাসীর
আয় ব্যয়ের হিসাব। রাষ্ট্রের সন্দেহভাজন উচ্চপদস্থ কর্মচারীর উপর নজরদারি, ম্যাজিস্ট্রেট
হিসেবে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। জনগণের নৈতিকতার উপর নজরদারি,বাজার ও দ্রব্যমূল্য
পর্যবেক্ষণ,পশু জবাই ও শ্মশান নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি।
কোতোয়াল শাহী সনদের মাধ্যমে নিযুক্ত হওয়ার ফলে তার
স্বাধীনতা ও মর্যাদা ছিলো ব্যপক।
১৭৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ঢাকা নগরীর কোতোয়াল সগৌরবে
দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তবে ১৭৯৩ সালের নায়েব নাজিরের নিজামত সংক্রান্ত দায়িত্বের
আনুষ্ঠানিক অবসান ঘটে। এর সঙ্গে সঙ্গে কোতোয়াল পদেরও বিলুপ্তি ঘটে।
তবে ১৮৪৩
সালের নামমাত্র কোতোয়ালপট্টি টিকে ছিল। নাম ও পদ বিলুপ্তি হলেও সেই সময়ের কোতোয়াল
টিকে আছে কোতোয়ালি থানার মাধ্যমে। বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি কোতোয়ালি থানা টিকে আছে।
এর মধ্যে ঢাকা, রংপুর, কুমিল্লা, খুলনা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, সিলেট
কোতোয়ালি থানা অন্যতম।
এখন আসা যাক মডেল থানা নিয়ে
মডেল থানার দায়িত্বে থাকেন এএসপি। মডেল থানা আধুনিক
সমাজের সুসজ্জিত থাকে। বাংলাদেশের সর্বপ্রথম মডেল থানা ভালুকা, ময়মনসিংহ। তবে আফসোসের
বিষয় এই বাংলাদেশে মডেল থানাগুলো শুধু মাত্র নাম এই মডেল। এটি কখনোই মডেল হয়ে উঠতে
পারেনি।
এমনই মন্তব্য করেছেন মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা।
তাদের মতে সব থানা একই। মডেল থানা হিসেবে যেসব উপকরণ ও সুবিধাদি থাকার কথা ছিল তা এখনও নেই।
আচ্ছা, আমরা কোতোয়ালি থানা মডেল থানা সম্পর্কে জানলাম।
এখন নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে হচ্ছে যে থানা কি? হ্যাঁ, এই প্রশ্নটা আসা স্বাভাবিক। হ্যাঁ,
আমি আপনাদের নিরাশ করবো না বলে দিচ্ছি থানা কি?
থানা
পুলিশ স্টেশন বা থানা বলতে বোঝায় যে কোন কেন্দ্র বা
এলাকার সরকার কর্তৃক ঘোষিত পুলিশ স্টেশন কে থানা বলে। থানার প্রধান, নির্বাহী অফিসার
ইনচার্জ (oc)। থানা হচ্ছে পুলিশের একটি ইউনিট আর থানার কাজ আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ
করা। একটি উপজেলায় একাধিক থানা থাকতে পারে।
পুলিশ নিয়ে অনেক আলোচনা করা হলো কিন্তু আসলে পুলিশের
পূর্ণরূপ কি তা কি আমরা জানি? চলুন তাহলে জেনে আসি পুলিশের বা পুলিশ শব্দের পূর্ণরূপ। পুলিশ শব্দটি এসেছে পর্তুগিজ ভাষা থেকে।
POLICE
P = polite (ভদ্র, শালীন, বিনম্র, শিষ্টাচার যুক্ত, বিনীত,
সভ্য।)
O = obedient (বাধ্য, আজ্ঞাবহ, কর্তব্যপরায়ণ, অনুগত,
বশীভূত, বশংবদ, আজ্ঞাকারী,বশবর্তী)
L=loyal (বিশ্বস্ত, কর্তব্য নিষ্ঠ, রাজভক্ত, প্রেমনিষ্ঠ
অনুরত, অনুগত।)
I=intelligent (বুদ্ধিমান, মতিমান, সুক্ষবুদ্ধি, মেধাবী,
ধীমান,মাথাওয়াল, মাথাল, চতুর।)
C=Courageous (সাহসী, নির্ভীক সাহসিক, নির্ভীক)
E=efficient (দক্ষ, কার্যকর, ক্রিয়াশীল, ফলপ্রদ,করিতকর্মা,কার্যক্ষম,
ভালো)
পুলিশের মূলনীত শান্তি-শৃঙ্খলা নিরাপত্তা ও প্রগতি। তাই
আমাদেরও প্রত্যাশা থাকবে পুলিশ বাহিনী তারা তাদের কাজটি মূলনীতি মেনে নিরাপদ বাংলাদেশ
গড়তে সহায়তা করবে।