মোবাইল- মোবাইল- মোবাইল!!! এখন এমন একটা যুগে আমরা বসবাস করছি যেখানে মোবাইল ফোন ব্যবহার করে না এমন লোক পাওয়া দুষ্কর। বাচ্চা থেকে বৃদ্ধ সবাই কোন না কোন ভাবে মোবাইল ফোনের সাথে পরিচিত। বরং বড়দের চেয়ে বাচ্চারা বেশী এর দ্বারা প্রভাবিত।
কিন্তু আমরা কি জানি যে , মোবাইল ফোন মানব জাতির জন্য কতটুকু ক্ষতিকর বা উপকারী? যে মোবাইল দ্বারা আমরা এত প্রভাবিত সেই মোবাইল নিঃসন্দেহে খুব প্রয়োজনীয় কিন্তু এর যে ক্ষতিকর কিছু দিক রয়েছে তাও আমাদের জানা দরকার। আর এই জানার প্রয়াসেই আজকে মোবাইল ফোন নিয়ে কিছু কথা বলা যাক।
মোবাইল ফোন মানব জাতির জন্য কতটুকু ক্ষতিকর বিস্তারিত
মোবাইল ফোন যেভাবে কাজ করে
আমরা একে অন্যের সাথে মোবাইল দিয়ে কথা বলি। কিন্তু কিভাবে? আসলে আমার ফোনের কথা তরঙ্গ হয়ে মোবাইল টাওয়ারে যায়। তারপর সেখান থেকে সেই সিগনাল যায় কৃত্রিম উপগ্রহে। সেই উপগ্রহ আবার যাকে ফোন দেয়া হয়েছে তার মোবাইলে পৌছে দেয়।
আর এভাবেই আমরা একে অন্যের সাথে কথা বলি। ব্যাপারটা যত সহজে বলা হয়ে গেল তত সহজ কিন্তু ছিল না। শত সহস্র মাইল পেরিয়ে মূহূর্তের মধ্যে এই এত কাজ হয়ে যায় তা সত্যিই এক বিরাট আবিষ্কার।
যাক মোবাইল কিভাবে কাজ করে এটা বলা মূল উদ্দেশ্য নয়। মূল আলোচনার বিষয় হল মোবাইল এর কি প্রভাব পড়ছে আমাদের জীবনে।
যেহেতু মোবাইল কাজ করার পেছনে মোবাইল টাওয়ার খুব জরুরি তাই টাওয়ার থেকেই প্রথম শুরু করা যাক। মোবাইল
টাওয়ার থেকে নির্গত রেডিয়েশনের কে বলে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন। এই রেডিয়েশন দুই প্রকার।
১. আয়োনাইজিং রেডিয়েশন।
২. নন আয়োনাইজিং রেডিয়েশন।
আয়োনাইজিং রেডিয়েশনে যে অণুর সৃষ্টি হয় তাতে একে অপরের সাথে কম্পন তৈরীর ফলে একে অপরকে খুব শক্তিশালী ভাবে ধাক্কা দেয় যার ফলে অণুতে অবস্থিত ইলেকট্রন বের হয়ে যায়। আর এটি খুব শক্তিশালী রেডিয়েশনের সৃষ্টি করে। আর এই রেডিয়েশান মানুষের নানা কঠিন রোগের জন্য দায়ী।
আর নন আয়োনাইজিং থেকে গামা, এক্সরে ,আল্ট্রাভায়োলেট নির্গত হয়। এর মধ্যে গামা রশ্মি যে কতটা ক্ষতিকর
তা নতুন করে বলারও দরকার পড়ে না।
অতীতে অনেক গবেষক মনে করতেন যে নিয়মিত মোবাইল ব্যবহারের ফলে মস্তিষ্কের টিউমার, নার্ভের ক্ষতি এমনকি ক্যানসারও হতে পারে।
কিন্তু এসব শারীরিক ক্ষতির পেছনে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় নি। তার মানে এই নয় যে মোবাইল ফোন সম্পূর্ণ
নিরাপদ। সুইচ গবেষক মার্টিন বুসলির মতে মোবাইল ফোনের রেডিয়েশন নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।
তাহলে কি উদ্বিগ্ন হওয়ার আসলেই কোনো কারণ নেই? হ্যা, আছে।
মোবাইল রেডিয়েশন ক্যান্সার বা টিউমার সৃষ্টি করে নাই কিন্তু অতীতে অন্য আর এক গবেষণায় দেখা গেছে মোবাইল
আমাদের ব্রেইনের ওয়েভের পরিবর্তন আনতে পারে।
আধুনিক গবেষক বুসলিই আবার বলেন তরুণ প্রজন্মের স্মৃতিশক্তির ওপর মোবাইলফোন বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে।
সুইচ গবেষকগণ ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সে ৭০০ কিশোর-তরুণ এর উপর বছরখানেক ধরে গবেষণা করেছেন।
ফলাফলস্বরূপ দেখা যায় মোবাইলের রেডিয়েশনে তাদের মস্তিষ্কের বিকাশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
মোবাইল ফোনের ব্যবহার কি পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে তার একটি পরিমাণগত ধারণা তুলে ধরা হল। এক গবেষণায় দেখা যায় ২০১৬ সালে মোবাইলের ব্যবহার ছিল ১.৬ বিলিয়ন। কিন্তু ২০২১ সালে এর সংখ্যা দাঁড়ায় ৩.৮ বিলিয়ন।
এতে করে সহজেই বোঝা যায় মানুষ দিন দিন মোবাইলের প্রতি কতটা আসক্ত হচ্ছে। তবে এর সবটা যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে সবার মাঝে তা কিন্তু নয়। তবে এই মোবাইল এর আসক্তি কি কোন ক্ষতি করছে আমাদের।
অতিরিক্ত মোবাইল আসক্তি কি কি ক্ষতি করে তা আমরা নিম্নে আলোকপাত করব।
১. দৃষ্টি শক্তি লোপ পাওয়া
মোবাইল স্ক্রিনে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে চোখের নানা সমস্যা দেখা দেয়। তবে নানা সমস্যার মধ্যে চোখ জ্বালা-পুড়া
করা এর মধ্যে অন্যতম। আর এভাবেই আস্তে আস্তে দৃষ্টিশক্তি লোপ পেতে পারে। দৃষ্টি লোপ পাওয়া হঠাৎ করে হয় না আস্তে আস্তেই হয়। তাই যদি এখন গুরুত্ব নাও দেই ভবিষ্যৎ এ এমন সমস্যা হতেই পারে।
মোবাইল স্ক্রিনে বেশীক্ষণ তাঁকিয়ে থাকলে মাথাব্যথার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। আর পাঠক এটা হয়ত আপনি নিজেও
বুঝতে পারেন কেননা মোবাইলটিতো আপনার হতেই আছে আর আপনি এটি ব্যবহারও করছেন।
২ ওজন বেড়ে যাওয়া
২০১৮ সালের জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সিমন বলিভার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মার্টফোন ব্যবহারকারী ১০৬০ জন ছাত্রছাত্রীর উপর গবেষনা করে দেখা যায় (৭০০ পুরুষ এবং ৩০০ নারী) যে ৩৬.১শতাংশ ছেলেদের ওজন বৃদ্ধির প্রবণতা পাওয়া যায়।
অন্যদিকে মেয়েদের ক্ষেত্রে ৬৩.৬% এর ওজন বিৃদ্ধি পায় । এই ছাত্র-ছাত্রীদের গড় বয়স ছিল পুরুষ-২০ এবং নারী ১৯ বছর। তাই ওজন বৃদ্ধির জন্যও মোবাইল ফোন দায়ী হতে পারে। এটি জানার পর আমি ব্যক্তিগত ভাবে একটু বিস্মিতই হই।
৪ শ্রবণ দুর্বলতা
মোবাইলের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে শ্রবণ শক্তি লোপ পায়। বিশেষ করে যারা উচ্চ শব্দে গান শুনে তাদের অন্তকর্ণের কোষ গুলোর ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে।
আরো পড়ুনঃ
৫ মোবাইলে জীবাণুর উপস্থিতি
একটি পাবলিক টয়লেটের সিটে যে পরিমাণ জীবাণু থাকে এর চেয়ে বেশি জীবাণু দেখা যায় মোবাইল ফোনে । এমনই দাবি করেছেন লন্ডন স্কুল অব হাইজিনের গবেষকগণ।
অথচ এটা সবসময়ই আমরা সাথে সাথে রাখি। যদি জীবাণু খালি চোখে দেখা যেত তাহলে হয়ত কেউ ধরতই না। তাই এক দিক থেকে ভালই হয়েছে আমরা জীবাণু দেখতে পাই না।
৬ পুরুষের শুক্রাণু কমে যেতে পারে
গবেষকদের দাবি মোবাইল ফোনের high-frequency কারণে পুরুষের প্রজননতন্ত্রেরও ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।
মোবাইলের ক্ষতিকর তরঙ্গ শুক্রাণুর ওপর প্রভাব ফেলে আর যার ফলে শুক্রাণুর ঘনত্ব কমে যেতে পারে।
৭ নৈতিক অবক্ষয়।
বর্তমানে বেশিরভাগ তরুন-তরুনী মোবাইলের গেমসের আসক্ত। আর সেই সাথে পর্র্ণগ্রাফি। আর এইসব দ্বারা ছেলে-মেয়েরা আসক্ত হয়ে যাচ্ছে। তাই পড়াশোনা বাদ দিয়ে অন্য দিকে ডাইভার্র্ট হচ্ছে। যা ছেলে মেয়েদের
খারাপ কাজে ধাবিত করছে।
সেই সাথে মোবাইল ফোন এখন আর এক নেশার নাম। কিছুক্ষন পর পর মোবাইল চেক করা, কে কি ম্যাসেজ দিল. ফেইসবুকে কি নোটিফিকেশন আসলো ইত্যাদি এখন প্রায় সব তরুণ, তরুণীর নিত্যনৈমিত্তিক অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। যার ফলে সবসময় নেতিবাচক চিন্তা ও কাজ দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে তরুণ সমাজ।
তাদের বেশিরভাগ সময় ভার্চুয়াল জগতে কাটানোর ফলে তাদের মধ্য থেকে নেতৃত্বগুন লোপ পাচ্ছে এবং সেই সাথে কমে
যাচ্ছে কর্র্মক্ষমতা। তাছাড়া সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও সহিষ্ণুতার মত ভাল গুণগুলো তাদের কাছ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।
মোবাইল ফোন নিয়ে কিছু কথা
অতীতের গবেষণা থেকে জানা যায় মোবাইলের রেডিয়েশন মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু আধুনিক গবেষকগণ মনে করেন 1.6 রেডিয়েশন মানব শরীরে কোনো প্রভাব ফেলে না।
কিন্তু এখানে প্রশ্ন হল গবেষণার ফল কোনটি সঠিক?
নাকি পুঁজিবাদী সমাজ আমাদের কোন অদৃশ্য আবেশে আবিষ্ট করেছে যে কারণে গবেষণার ফলাফলও বহুমাত্রিকতা পেয়েছে।
প্রযুক্তি কি আমাদের সোনালী শৈশব কেড়ে নেয় নি? প্রযুক্তি যেমন করে সমগ্র দুনিয়াকে হাতের মুঠোই এনে দিয়েছে
সেই সাথেতো অপরাধও বৃদ্ধি করেছে। তাই না?
পড়াশুনার ক্ষেত্রে কতটুকু ব্যবহার হয় মোবাইল? যেটুকু ব্যবহার হচ্ছে তার চেয়ে বেশী বিনোদনই ছেলেমেয়েদের
টানে। কেউ হয়ত পড়ার জন্য ইউটিউবে ঢুকল কিন্তু হঠাৎ চোখে পড়ল নতুন সিনেমা রিলিজ হয়েছে। ব্যাস পড়াশোনা এখানেই শেষ। এইসব কি হচ্ছে না আমাদের সাথে?
মাঝে মাঝে কি মনে হয় না ফেসবুক মেসেঞ্জার টা একটু চেক করে আসি কেউ কিছু আপলোড দিল কিনা? এই কমন সমস্যা এখন প্রত্যেকের মাঝেই বলা চলে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার মানুষ তুলনামূলক কমই পাওয়া যাবে। তাই এইসব সমস্যা যে অধিকাংশ মানুষের ক্ষতি করছে তাতে সন্দেহ রাখার কি কোন উপায় আছে?
শিশুদের ক্ষেত্রে তো কার্টুন ছাড়া তাদের খাওয়ানো দুষ্কর। এই সমস্যা এখন ঘরে ঘরে। শিশুরা খেতে চায় না। এই জন্য এখনকার বাবা মারা ডাক্তারও দেখায়। আর আমাদের শিশু কালে মায়েরা বলত হইছে আর খাওয়ার দরক্র নেই।
আর এরা এখন এত পেয়েও খায় না। তখন মোবাইলটা হাতে ধরায়া দিলেই খাওয়া শুরু। আহারে কি শৈশব ছিল আর এখন কি মোবাইল মার্কা শেশব চলছে।
আর এই সমস্যা ফলে শিশুরা খাবারের প্রতি মনোযোগ হারাচ্ছে। যা তাদের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। শিশুরা কোন খাবারের কি স্বাদ তারা কি বুঝতে পারে ? মোবাইলের ছলে শুধু কি উদরপূর্তি হচ্ছে না?
তাই এই আসক্তি থেকে আপনার সন্তানসহ নিজের পরিবারের শিশুদের রক্ষা করুন। শিশুদের শৈশব মোবাইলে আবদ্ধ করে আমরা ভুল করছি না তো? আমরা কি রচনা করছি তাদের অন্ধকারময় অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ?
সবশেষ কথা হলো, আমরা দা দিয়ে মানুষও হত্যা করতে পারবো আবার সবজিও কাটাতে পারবো । কোনটা করব তা আমাদের ব্যাপার। কিন্তু দুঃখ জনক হলেও সত্য, মোবাইল ফোন আমাদের যখন ক্ষতি করছে তখন বুঝতে পারি কিন্তু নিজেকে ফেরাতে পারি না।
আর এই সমস্যাটাই একদিন সুন্দর জীবনকে ধ্বংস করবে। তাই মোবাইল ফোন আমাদের অবশ্যই প্রয়োজন কিন্তু এর সঠিক ব্যবহার আমাদের জানতে হবে। মোবাইল ফোনের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যকে কোন না কোনভাবে ফেলে দিচ্ছে হুমকির মধ্যে।
তাই আসুন সবাই মোবাইলের সঠিক ব্যবহার করি আর তা না হলে একটা মোবাইলই আমাদের জীবন ধ্বংসের জন্য যথেষ্ট হবে।
Khub valo laglo likhata….mobile khub dorkari but bebehar janata besi dorkari…