রিয়েলিজম ও ন্যাচারিলিজম এর তুলনামূলক আলোচনা জানার আগে আমরা রিয়েলিজম ও ন্যাচারিলিজম বিষয়ে প্রাথমিক আলোচনা করবো।
কেননা এদের সময়কাল ও উপস্তাপনে খুব বেশী পার্থক্য পাওয়া যায় না। তারপরও বিভিন্ন জায়গায় যেসব পার্থক্য করা যায় তাই তুলে ধরা আমাদের আজকের প্রয়াস।
রিয়েলিজম ও ন্যাচারিলিজম এর তুলনামূলক আলোচনা
মানুষের জীবনের আশেপাশের অবস্থা, ঘটনা, জীবন নির্ভর ও জীবনের সকল ক্রিয়া-কর্মকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল এই দুটি ইজম। যদিও মোটা দাগে এদের খুব একটা পার্থক্য করা যাবে না, কিন্তু তত্ত্ব ও প্রায়োগিক অবস্থার নিরিক্ষে এদের কিছু সূক্ষ্ম পার্থক্য দেখা যায়।
এক কথায় ও এক বাক্যে বলতে গেলে বলতে হবে এই দুটি ইজমই জীবন নির্ভর।
ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি ইউরোপের মানুষের জীবনযাত্রায় জ্ঞান- বিজ্ঞানের প্রভাবে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। শিল্প, কৃষি, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ সকল ক্ষেত্রেই বিজ্ঞানের প্রভাবে উন্নতি প্রতীয়মান হয়। যার ফলশ্রুতিতে নিম্ন শ্রেনী থেকে বুর্জায়া শ্রেণী, শ্রমিক থেকে কবি-সাহিত্যিক সকলেরই জীবনযাত্রায় পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়।
সেই পরিবর্তনের গতিবেগকে পুঁজি করেই শিল্পের নানা শাখায় নতুন নতুন চিন্তার আগমন ঘটে। সেই চিন্তারই একটি রুপ হচ্ছে রিয়েলিজম। জীবনে কল্পনা, আবেগ-অনুভূতি, অতিপ্রাকৃত বিষয়বস্তুকে বাদ দিয়ে প্রাধান্য দেয়া হয় বাস্তবতার।
বাস্তবে যা ঘটে, ঘটছে এবং সামনে ঘটবে অর্থাৎ যা কিছুর অস্তিত্ব ছিল , আছে বা থাকবে তাই রিয়েলিজম এর ভিত্তি।
অপরদিকে ন্যাচারিলিজম বাস্তববাদ থেকে আরও একধাপ এগিয়ে বলে যে, প্রকৃতিতে যা আছে তার যথাযথ ও পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ ও প্রকৃতিকেই প্রাধান্য দিয়ে প্রকৃতির রুপে জীবনকে দেখা। রিয়েলিজম এর অতিরিক্ত রুপ ন্যাচারিলিজম।
রিয়েলিজম ও ন্যাচারিলিজম এর তুলনামূলক আলোচনা পর্ব-২
ন্যাচারিলিজম গড়ে উঠে রিয়েলিজম এর সামাজিক অবস্থান, বংশগতি এবং পরিবেশ এই তিন মূল শক্তির উপর নির্ভর করে।
১৮৫০ সালের আগে থেকেই রিয়েলিজম এর সরব পদক্ষেপ অনুভূত হচ্ছিল, বিশেষভাবে চিত্রকলায়। প্যারিসই ছিল রিয়েলিজম এর চারণভূমি।
অন্যদিকে ন্যাচারিলিজম এর প্রথম প্রবক্তা উপন্যাসিক নাট্যকার এমিল জোলা্ । তিনি ১৮৭০ সালে “দি ন্যাচারিলিজম ইন থিয়েটার” শীর্ষক রচনায় ন্যাটারিলিজমকে কাঠামোগত রুপদানের চেষ্টা করেন।
আরো পড়ুনঃ
ভালোবাসার ছন্দ॥ কষ্টের স্ট্যাটাস॥প্রেমের কবিতা॥sms Best 2023
ন্যাচারিলিজম এর প্রথম প্রবক্তা জোলা, তার মতবাদের ভিত্তি হচ্ছে বাস্তবতার প্রক্ষিতে ও আলোকে মানবিক সম্যাসমূহ বিচার করা।
যেহেতু নাট্যকার এমিল জোলা এর প্রবক্তা , সেহেতু নাট্য সাহিত্যেই এর প্রভাব প্রথম লক্ষ্য করা যায়।
রিয়েলিজম এর অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে, সামাজিক আচার-বিধি ব্যবস্থাকে পরীক্ষা ও বিচার করা, মানবতাবাদের আদর্শ নিয়ে মানুষের জীবনের উন্নতি সাধন। আর ন্যাচারিলিজম এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, একজন শল্য চিকিৎসক যেভাবে শব ব্যবচ্ছেদ
করে থাকে, তেমনিভাবে জীবন ও বাস্তবতাকে দেখা।
বাস্তববাদের মৌলনীতি হচ্ছে, সমসাময়িক জীবনের সত্যনিষ্ঠ রুপায়ন, সত্যিকার জীবনধারার ও ঘটনাবলীর অনুকরন।
অন্যদিকে ন্যাচারিলিজমের মৌলনীতি ও সবচেয়ে গুরুত্বরোপ করা হয় প্রত্যক্ষ কোন কিছু দেখার মধ্য দিয়ে।
প্রকৃতপক্ষে দুই ইজমের মূল পার্থক্য হচ্ছে, রিয়েলিজম বাস্তব জীবনকে তুলে ধরে আর ন্যাচারিলিজম আরও বেশী মাত্রায় বৈজ্ঞানিক ও নিখুঁও বিশ্লেষন করে জীবনকে দেখে। এই দুটি ইজম এরই প্রভাব পড়ে চিত্রকলায়, থিয়েটারে, সাহিত্যের নানা শাখায়।
রিয়েলিজম ও ন্যাচারিলিজম এর তুলনামূলক আলোচনা পর্ব-৩
চিত্রকলায় রিয়েলিজমের যে বাস্তবতা তুলে ধরা হয় ন্যাচারিলিজমের চিত্রে সেই একই বাস্তব তুলে ধরলেও তা অনেক বেশী ডিটেইল। শুধু বাস্তববাদের চেয়ে ন্যাচারিলিজমে বিস্তৃত ও ব্যাপকভাবে প্রকৃতিকে তুলে ধরার প্রয়াস দেখা যায়।
থিয়েটারে নাট্য উপস্থাপনায় জীবনের আচরন, পরিবেশ ও প্রকৃতির প্রতিফলন ও অনুকরন ঘটানো হয়। উভয় ধারার নাটকেই সত্যকার বাস্তবতাকেই তুলে ধরা হয়। তবে রিয়েলিজমের নাটকে বাস্তবতাকে বাস্তবের মত করে তুলে ধরলেও ন্যাচারিলিজমে বাস্তবতাকে হুবুহুব তুলে ধরা হয়।
দুটো ইজমই জীবন ও মানবিকতার ক্ষেত্রে একই ভিউ ধারণ করলেও ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভিন্ন্। আর তা হল একটি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক এবং অন্যটি বাস্তবিক।
রিয়েলিজম হল জীবনের বিশ্বাসযোগ্য ঘটনা আর ন্যাচারিলিজম হল এক ঘটনাকে ধারাবাহিকভাবে ও বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করা। ন্যাচারিলিজমে মানুষকে যেন তার প্রকৃতি, বংশগতি ও সামাজিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী নিজেদের মানিয়ে চলতে বাধ্য করা হয়।
এখানে মানুষ তার পরিস্থিতির শিকাড় এমনটাই ধরা হয়।
রিয়েলিজম ও ন্যাচারিলিজম এর তুলনা পর্ব-৪
রিয়েলিজম এর মূল ফোকাস হল মধ্যবিত্ত শ্রেণী ও তাদের নানা সমস্যা নিয়ে। অন্যদিকে ন্যাচারিলিজমের মূল ফোকাস অল্প শিক্ষিত ও নিম্ন শ্রেণী পেশার মানুষদের ও তাদের হিংসা বা স্বনির্ধারিত নিষেধাজ্ঞার উপর।
দার্শনিক দিক থেকে বিবেচনায় ন্যাচারিলিজম যে বিষয়ের উপর জোর দিল তা হচ্ছে শিল্পকলা অধিকতর বিজ্ঞানসম্মত হবে তার নিয়ম শৃঙ্খলায় ও পদ্ধতিতে।
অন্যদিকে রিয়েলিজম এর দর্শণ হলো বিশ্বাসযোগ্য বাস্তবতাকেই তুলে ধরা। নিয়ম-শৃঙ্খলা বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতেই এগিয়ে যেতে হবে তার বাধ্যবাধকতা খুব বেশী দেখা যায় না।
রিয়েলিজমে শিল্পের বাস্তবতার বাস্তবকে ঠিক ততটুকুই গ্রহণ করা হয় যেটুকু প্রয়োজন। কিন্তু ন্যাচারিলিজমের শিল্পে প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় সমস্ত বাস্তবতাকেই ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়।
রিয়েলিজমে বিশ্বাসযোগ্য বাস্তবের সাথে প্রাকৃতিক ব্যাপারগুলো থাকে আর ন্যাচারিলিজমে প্রকৃতি নিজেই একমাত্র শক্তি ও শক্তির নির্ধারক হিসেবে উপস্থিত হয়।
Thanks