মানুষের রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ যদি ৭ মি.লি এর বেশী হয় তাহলে তাকে ডায়বেটিস রোগী হিসাবে বিবেচনা করা হয়। তবে এই পরিমাণ হতে হবে খালি পেটে।ডায়াবেটিস রোগীর নিষিদ্ধ খাবার তালিকা জানাবেন কখন? যখন জানবেন যে ডায়বেটিস হলে আপনার প্রথমেই কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে যেমন চোখের সমস্যা ,কিডনি ড্যামেজ, হার্টের সমস্যা ইত্যাাদি। আর ডায়বেটিস যদি নিয়ন্ত্রনে না আনা যায় তাহলে আপনার মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
আর নিয়ন্ত্রন রাখতে আপনাকে প্রথমেই খাবারের দিকে নজর দিতে হবে। বেছে বেছে নিয়ম অনুযায়ী খেতে হবে। কারণ এই খাবার থেকেই রক্তে গ্লুকোজ মিশে যায়। তাই ডায়াবেটিস রোগীর ৫ নিষিদ্ধ খাবার তালিকা অনুযায়ী খাবার খেতে হবে। কখনই এইসব খাবার খাওয়া উচিৎ হবে না।
আর শুধু খাবার খেলেই কী হবে? না সেই সাথে আপনাকে নিয়মিত ব্যায়ামও করতে হবে। যখন খাবার ও ব্যায়াম করবেন তখন আপনার ডায়বেটিস হলেও থাকবেন চিন্তামুক্ত।
ডায়াবেটিস রোগীর নিষিদ্ধ খাবার তালিকা
১. চিনি ও মিষ্টি জাতীয় খাবার :ডায়াবেটিস রোগীর নিষিদ্ধ খাবার তালিকা
চিনি ও মিষ্টি খাবার রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বৃদ্ধি করে। তাই ডায়বেটিস হওয়ার পর প্রথম আপনাকে চিনি হারাম হিসেবে নিতে হবে। আবার অনেকে মনে করেন যে চিনি খেলে ডায়বেটিস হয়। কিন্তু তা সত্য নয়। এই আলোচনা অন্য আর একটা আর্টিকেলে করবো ইনশা্ল্লাহ।
রক্তের শর্করার পরিমাণ বৃদ্ধি করবে এমন কিছু খাবার তালিকা তুলে ধরলাম। যা আপনি অবশ্যই ত্যাগ করবেন:
- মিষ্টি
- চিনি
- কোমল পানীয়
- চকলেট
- আইসক্রিম
- কেক, ডোনাট সহ প্রসেসড মিষ্টি জাতীয় খাবার
২. পরিশোধিত কার্বোহাইড্রেট :ডায়াবেটিস রোগীর নিষিদ্ধ খাবার তালিকা
পরিশোধিত কার্বোহাইড্রেট বা Refined Carbohydrate দিয়ে তৈরি খাবার খুব সহজেই পেটে গিয়ে হজম হয়ে যায় এবং দ্রুত রক্তে মিশে যায়। যার ফলে রক্তে গ্লুকোজ এর লেভেল বেড়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ:
- সাদা চালের ভাত
- সাদা আটার রুটি
- নুডলস্
- পাস্তা
৩. আল্ট্রা-প্রসেসড ফুড
টাইপ টু ডায়াবেটিসের সম্ভাবনা অনেকাংশেই প্রায় ১২% বেড়ে যায় আল্ট্রা-প্রসেস ফুড খাওয়ার ফলে। আপনার প্রশ্ন আসতে পারে কোনগুলো আবার আল্ট্রা প্রসেস ফুড!!! রেডি-টু-ইট ফুডই আল্ট্রা প্রসেস ফুড এর মধ্যে পড়ে। যেমন:
- ইনস্ট্যান্ট স্যুপ
- ফাস্টফুড
- জাঙ্ক ফুড
- চিপস
- বিস্কুট
- প্রেসেসড মিট ( সসেজ, চিকেন বল)
- প্যাকেটজাত খাবার
৪. উচ্চ গ্লাইসেমিক ইন্ডেক্স (High Glycemic Index) সমৃদ্ধ খাবার
উচ্চ গ্লাইসেমিক ইনডেক্স সমৃদ্ধ খাবার বেশি খাওয়ার ফলে রক্তে ইনসুলিন নিঃসরণের সঠিক পরিমাপ ব্যাহত হয় এবং ইনসুলিন কার্যক্ষমতা হারায়। যার ফলে টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেড়ে যায়। উচ্চ গ্লাইসেমিক ইন্ডেক্স যুক্ত কিছু খাবার হল:
- আলু
- পপকন
- কনফ্লেক্স
- ফ্রেঞ্চ ফ্রাই
- গ্লুকোজ
৫. ট্রান্স ফ্যাট ও স্যাচুরেটেড ফ্যাট যুক্ত খাবার
ট্রান্স ফ্যাট ও স্যাচুরেটেড ফ্যাট যুক্ত খাবার আমদের শরীরের ওজন বৃদ্ধি করে। সেই সাথে ইনসুলিনের কার্যকারিতা কমিয়ে ফেলে। যে কারণে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। ট্রান্স ফ্যাট ও স্যাচুরেটেড ফ্যাট যুক্ত কিছু খাবার:
- প্রক্রিয়াজাত স্ন্যাকস
- মার্জারিন
- ফাস্টফুড
- তেলে ভাজা খাবার
এইসব খাবার ডায়াবেটিস রোগীর নিষিদ্ধ খাবার তালিকা। কথা হচ্ছে এইসব খবার খেতে অনেক মজা হলেও তা বাদ দিতে হবে।
আমার বাবা ডায়বেটিস আক্রান্ত ছিলেন কিন্তু তিনি ৩ বেলাই ভাত খেতেন। অবশেষে তাঁর প্রস্রাবে পটাসিয়াম নীল হয়ে যাওয়ার দরুন সে স্ট্রোক করে মারা যান এমন আরও অনেক রোগী আমাদের আশেপাশে রয়েছে, যাদের সমস্যা একটাই খাবার নিয়ন্ত্রনে নেই।
আসলে এত মজার মজার কাবার আমরা চাইলেই ত্যাগ করতে পারি না। কিন্তু কি করা যাবে বাঁচতে হলেতো অবশ্যই ডায়বেটিস এর নিষিদ্ধ খাবার না খেয়েই থাকতে হেব।
আচ্ছা এতক্ষণ বললাম ডায়াবেটিস রোগীর নিষিদ্ধ খাবার তালিকা। এখন তাহলে বলি কি কি খেতে পারবেন। যাক এখন হয়ত আশা ফিরে পেলেন।
কি কি খাবার ডায়বেটিস হওয়ার পর খাওয়া যাবে।ডায়াবেটিস রোগীর নিষিদ্ধ খাবার তালিকা
মূল কথা ভাই্ একটাই রক্তে গ্লকোজ বা শর্করার মাত্রা ঠিক থাকলেই আপনার ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রনে। তাই এমন খাবার আপনাকে খেতে হবে যেগুলো আস্তে ধীরে হজম হয়। আর এইসব খাবার খেলে আপনিও থাকবেন ডায়বেটিস এর কবল মুক্ত।
১. ফাইবার / আঁশ সমৃদ্ধ খাবার
আঁশ বা ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার যেমন ফল, শাকসবজি ও শস্য সহজে হজম হয় না । আর যে কারণে রক্তের শর্করা দ্রুত বৃদ্ধি পায় না। এই খাবারগুলো খাদ্য পরিপাককে উন্নত করবে এবং আপনার ডায়বেটিস রাখবে নিয়ন্ত্রনে।
আঁশ বা ফাইবার সমৃদ্ধ কিছু খাবারতালিকা:
- ডাল
- ফরমূল
- শাকসবজি
- মটরশুটি
- বাদাম
- গোটা শস্য
- ওটস
২. প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার
আমাদের ক্যালরির ২০% পেয়ে থাকি প্রোটিন থেকে। মজার ব্যাপার হলো প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার খেলে আমাদের ক্ষুধা কম লাগে যার ফলে কার্বোহাইড্রেটযুক্ত খাবার আমরা কম গ্রহণ করি। আর যে কারণে ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রনে থাকে।
প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবারের তালিকা তুলে ধরলাম:
- ডিম
- ডাল
- সয়া
- মাছ (বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছ যেমন : স্যামন টুনা)
- মুরগি
৩. অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার
শাকসবজি ও ফলমূলে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে। এ খাবারগুলো ডায়াবেটিস রোগীর শরীরের বিভিন্ন ক্ষতিগ্রস্ত মারাত্মক কোষ গুলোকে ঠিকঠাক রাখতে সহায়তা করে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবারের উদাহরণ:
- বেরি জাতীয় ফল( ব্লুবেরি, স্ট্রবেরি )
- গ্রিন টি ব্রকলি
- বাদাম
- টমেটো
- উদ্ভিজ্জ তেল
- জলপাই
৪. স্বাস্থ্যকর চর্বি
সব চর্বি যে আমাদের শরীরের ক্ষতি করবেব তা কিন্তু নয়। মোনোআনস্যাচুরেটেড এবং পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট স্বাস্থ্যকর চর্বি। আর এইগুলো ইনসুলিনের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এখানে কয়েকটি স্বাস্থ্যকর চর্বির বা ফ্যাট এর নাম দেয়া হল:
- অ্যাভোকাডো
- অলিভ অয়েল
- বাদাম
ডায়াবেটিস রোগীর প্রতিদিনের খাদ্য তালিকা কিভাবে সাজানো যায় চলুন জেনে নেই।
ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্য তালিকা তৈরীর সময় অবশ্যই চিনি এবং কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার হ্রাস করে ভিটামিন সমৃদ্ধ ও পুষ্টিকর খাবারের পরিমাণ বেশি রাখতে হবে। ডায়াবেটিস রোগীর নিষিদ্ধ খাবার তালিকা মেনে আপনাকে খাবার রুটিন তৈরী করতে হবে।
খাদ্য তালিকা তৈরির ক্ষেত্রে কিছু পরামর্শ:
কার্বোহাইড্রেট নিয়ন্ত্রণ:
আপনার যদি ডায়বেটিস হয় তাহলে আমি বলবো প্রথমেই কার্বোহাইড্রেড কমাতে হবে। যেহেতু বাঙালি পেট ভরে ভাত না খাইলে আমাদের ঘুম হয় না তাই কার্বোহাইড্রেড খেতে হবে পরিশাণ মত। শাক, সবজি বা আশযুক্ত খাবার দিয়েই হোক যাত্রো শুরু।
প্রচুর পানি পান করা:
ভাইরে ভাই কথায় আছে পানির বিকল্প শুধু পানি। বেশী পানি খায় যে বেশী দিন বাঁচে সে। আসলে এই কথাটা সত্য কি না জানি না কিন্তু পানির গুরুত্ব বোঝাতে এই কথাটা বলা হয়ে থাকে।
পানি প্রস্রাবের মাধ্যমে আমাদের দেহে যে অতিরিক্ত গ্লুকোজ রয়েছে তা বের করে দেয় এবং সেই সাথে ডিহাইড্রেশন এর সমস্যা থাকলে তাও দূর করে। তাই ডায়বেটিস এর রোগী হিসেবে পরিশাণ মতন পানি পান করুন।
আলাদা আলাদা স্ন্যাকস :
এই এক সমস্যা, ডায়বেটিস হলে যেন মানুষ রাক্ষস হয়ে যায়। একটু পর পর ক্ষুধা লাগে। আমারও একটু পর পর ক্ষুধা লাগে। ভাবলাম তাহলে এইবার নিশ্চিত ডায়বেটিস হইছে। কিন্তু না আ্ল্লাহ বাচাইছে ডায়বেটিস হয় নি। মূল কথা বলি আজাইরা পেচাল বাদ দিয়া। আপনি দুই বেলা খাবার এর মাঝে একবার হালকা স্ন্যাকস খাবেন। এখন ভাবছেন কি খেতে পারেন, বাদাম,ফল, টক দই, সালাদ ইত্যাদি খেতে পারেন।
প্রোটিন বাড়ানো:
প্রতিদিন প্রটিন খাবার খান। এতে করে আপনার পেট দীর্ঘক্ষণ ভরা থাকবে এবং আপনি থাকবেন চিল মুডে। তাই প্রতিদিন অবশ্যই ডিম, ডাল, মাছ, মাংসের মত প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবারগুলো খাদ্য তালিকায় রাখাতে হবে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশেষ টিপস :ডায়াবেটিস রোগীর নিষিদ্ধ খাবার তালিকা
নিয়মিত ব্যায়াম করুন:
নিয়মিত ব্যায়াম অপরিহার্য তা আমরা কমবেশী সবাই জানি। ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রনে আমরা নিয়মিত ব্যায়াম অবশ্যই করতে পারি। ডায়াবেটিস রোগীর প্রতিদিন কমপক্ষে ১০ হাজার স্টেপ দেয়া উচিৎ। সকালে এবং বিকালে অন্তত ৩০ মিনিট করে হাঁটা উচিত। যদি আপনি নিয়মিত ব্যায়ম করেন তাহলে আপনার রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রনে থাকবে। সো গুড লাক, শুরু করুন আজকে থেকে হাকঢাক।
ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন: খাইছেরে এখানেই যত সমস্যা। খাইতে বসলে মাথা ঠিক থাকে না। পরিশ্রমের কাজ করতে বললে আগেই যাই যাই অবস্থা। তাহলে ওজন বাড়বে না কমবে???!!! আমাদের এখন অধিকাংশ সমস্যার মূলে হল ওজন এর সমস্যা। এই অতিরিক্ত ওজন ডায়বেটিস এর সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। তাই নিয়মিত ব্যায়াম , খাবচার নিয়ন্ত্রন এর মাধ্যমে মাস্টবি ওজন নিয়ন্ত্রনে রাখতে হবে।
নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা করুন:
ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সপ্তাহে অন্তত ১ দিন খাবার আগে এবং খাবার ২ ঘন্টা পরে রক্ত পরীক্ষা করা উচিত। রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেশী হলে সাথে সাথে পদক্ষেপ শুরু। খাবার আরও নিয়ন্ত্রনে আরও্র হাটতে হবে এবং পরিশ্রম করতে হবে। তাই নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা করে জানা থাকতে হবে আপনার রক্তে গ্লুকোজ এর মাত্রা কি আছে।
উপসংহার:
ডায়াবেটিস রোগীর নিষিদ্ধ খাবার তালিকা দিতে গিয়ে আরও কিছু বোনাস বিষয় আলোচনা করে নিলাম। সঠিক ও নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস এবং নিয়মিত ব্যায়াম ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করার চাবিকাঠি। মূল বিষয় আপনারা ভাল থাকেন। সঠিক জীবনযাপনই পারে আপনাকে ভাল রাখতে।
যেসব খাবার নিষিদ্ধ তা কখনোই খাবেন না, আর যে সব খাবার খেতে বলেছি তা নিয়ম করে সকাল বিকাল খাওয়ার অনুরোধ রইল। ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রনে রাখুন, সুস্থ থাকুন ও সুন্দর জীবন যাপন করুন।