আমাদের উপমহাদেশে এখন যত বড় বড় স্থাপনা দেখি তার অধিকাংশ মুঘল রাজারা স্থাপন করেছিলেন। যে সব স্থাপনার নান্দনিকতা দেখার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ ভিড় করে আমাদের এই উপমহাদেশে।
যেহেতু ১৯৪৭ এর আগে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশে নিয়ে একটাই দেশ ছিল তাই তখনকার ইতিহাসই আমাদের নিজস্ব ইতিহাস।
যেহেতু মুঘল রাজারাই আমাদের রাজ্য পরিচালনা করতেন তাই আমরা যখন বাংলার ইতিহাস জানতে চাইবো তখন অবশ্যই আমাদের মুঘল রাজাদের শাসনব্যবস্থা ও সেই সময়কার সাধারণ জীবনব্যবস্থা সম্পর্কে জানা উচিত।
মুঘল রাজাদের খাওয়া-দাওয়া বিস্তারিত
যে রাজারা এমন নান্দনিক আর চমৎকার স্থাপত্যশিল্প তৈরী করেছিল, তাদের রুচি কতটা উচ্চমানের হবে তা স্থাপত্যশিল্প দেখেই বোঝা যায়। তাই তাদের রুচি সম্পর্কে জানার জন্যই কেমন ছিল মোঘল রাজাদের খাওয়া-দাওয়া তা নিয়ে আলোচনা ও জানার চেষ্টা করবো এখন।
মুঘল রাজাদের খাবার গ্রহণ যেন এক উৎসবের আয়োজন। বহু দাস-দাসী ছিল যাদের কাজ ছিল শুধু খাবার তৈরী করা। রান্না, পরিবেশন, আয়োজন ইত্যাদি সব মিলে মুঘল রাজাদের জন্য যে আয়োজন করা হতো তাতেও ছিল নান্দনিকতা।
যেহেতু রাজারা তাদের পছন্দের বাইরে কোন খাবার খেতে চাইতেন না সেহেতু কতটা যত্ন নিয়ে খাবার রান্না হতো তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আবার কেউ কেউ রান্না টেস্ট কেমন হয়েছে তা দেখার জন্য রান্না পরখ করার বিশেষজ্ঞও
রেখেছিলেন।
তিনি যদি বলতেন যে খাবার ভাল হয়েছে তাহলেই রাজা মুখে খাবার তুলতেন। অন্যথায় চেখে দেখারও প্রয়োজন মনে করতেন না। আর এর মাধ্যমেই বোঝা যায় তারা কেমন সৌখিন মানুষ ছিলেন।
এখানে বাবর থেকে বাহাদুর শাহ জাফর পর্যন্ত মুঘল রাজাদের খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হয়েছে।
মুঘল রাজা বাবর
যিনি এই উপমহাদেশে মুঘল সাম্রাজ্যের সূচনা করেছিলেন তিনি হলেন বিখ্যাত সম্রাট বাবর। প্রথম যেহেতু তিনি এই উপমহাদেশে এসেছিলেন তাই তার কাছে এখানকার মানুষের খাবার ছিল পুরোপুরি নতুন। এই উপমহাদেশে পাওয়া যায় এমন বিভিন্ন মশলা খেয়ে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু সম্রাট বাবর তার জন্মস্থানের খাবারের জন্যই বেশী নস্টালজিক ছিলেন।
আরো পড়ুনঃ আকাশের দিকে তাকিয়ে যা যা প্রশ্ন তোমার মনে আসে তা লিখে রাখ এখানে।
তিনি তার নতুন আবাসে বেশিরভাগ জিনিসই অপছন্দ করতেন এবং সবসময়ই তিনি তার জন্মস্থানের খাবারের
প্রশংসা করতেন। তিনি আঙ্গুর এবং কস্তুরি বেশী পছন্দ করতেন। আর এই ফলগুলো তার জন্মস্থানের অন্যতম ফল ছিল।
যার ফলশ্রুতিতে বাবর, তার জন্মভূমি থেকে এই দেশে ফল আনার ব্যবস্থাও করেছিলেন। বাবর তুলনামূলক ভারী খাবারের চেয়ে ফলই বেশী পছন্দ করতেন বলে অনুমান করা হয়। ইতিহাসবিদ লিজি কলিংহাম লিখেছেন যে, তরমুজের স্বাদ বাবরকে এতটাই মুগ্ধ করেছিল যে তিনি এটি খেতে গিয়ে কাঁদতে শুরু করেছিলেন।
মুঘল রাজা হুমায়ুন
হুমায়ুনকে ভারত থেকে বিতাড়িত করেন শের শাহ। এরপর তিনি পারস্যে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আর ঐ সময় ভারতীয় রাঁধুনিরা তার জন্য মটর ও চাল দিয়ে একপ্রকার খিচুড়ি রান্না করেছিলেন। আর তিনি সেই খিচুড়ি খুবই পছন্দ করেছিলেন।
পারস্য থেকে চলে আসার সময় তিনি তার সাথে ফার্সি রাঁধুনিকে নিয়ে আসেন এই ভারত উপমহাদেশে। যারা এইখানকার স্থানীয় খাবারের সাথে ফার্সি রন্ধনপ্রণালী মিশ্রিত করেছিলেন। আর দুই দেশের রন্ধনপ্রণালীর মিশ্রিণে যে রান্না হতো তা রাজার খুব পছন্দ হয়েছিল।
তার সময়ে খাবারে প্রচুর জাফরান ও শুকনো ফল ব্যবহার করা হতো। তবে হুমায়ুন ফল দিয়ে তৈরী শরবত খেতে খুব পছন্দ করতেন।
আরো পড়ুনঃ
আকবরঃ মুঘল রাজা
আকবর উপমহাদেশের খাবারের অনুরাগী ছিলেন। কথিত আছে যে তিনি অনেক দিন সম্পূর্ণ নিরামিষ খেয়েছেন। তিনি তার বাবার মতো পর্যায়ক্রমে সাধারণত খিচুড়ি খেতেন।
খাবার নিয়ে তার তেমন মাথাব্যাথা ছিল না। বেছে বেছে পছন্দের জিনিসটাই খেতে হবে তার কাছে ব্যাপারটা তেমন ছিল না। তার শাসনামলে মুরগ মোসাল্লামের মতো মাটন খাবার জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
মুঘল রাজা জাহাঙ্গীর
অন্য সব মুঘল সম্রাটের চেয়ে জাহাঙ্গীর খাওয়া-দাওয়া বেশি পছন্দ করতেন। তিনি কাবুল ফলের চেয়ে আম বেশি পছন্দ করতেন।
তবে তিনি মদ্যপানের জন্য নিজেই উৎপাদনের ব্যবস্থা করেছিলেন। তবে তার সম্পর্কে যা জানা যায় তাতে বলাই যায় যে তিনি ভোজনরসিক ছিলেন।
মুঘল রাজা শাহজাহান
শাহজাহান, অধিকাংশ মুঘল সম্রাটের মতো আম ও ফলমূল বেশী পছন্দ করতেন। তিনি শুধু যমুনা নদীর পানি পান করার কথাও বলেছেন। শাহজাহানের রান্নার উপাদানগুলি বাগান থেকে টাটকা ও তরতাজা সংগ্রহ করা হতো।
তার বাগানে তাজা ফল এবং শাকসবজি জন্মানো হতো। কথিত আছে যে মশলাদার মাংসের থালা, নিহারী ইত্যাদি জনপ্রিয় কিছু ভারতীয় উপমহাদেশের খাবার তার রাজত্বকালেই তৈরি হয়েছিল। আর এতে তো বলই যায় যে, খাবারের ব্যাপারে শাহজাহান ছিল ভোজন রসিক।
মুঘল রাজা আওরঙ্গজেব
অন্যান্য মুঘল সম্রাটদের তুলনায় আওরঙ্গজেব তার খাদ্যাভ্যাসে অত্যন্ত কঠোর ছিলেন। তিনি বেশিরভাগই নিরামিষ খাবার খেতেন এবং কুবুলি নামক একটি খাবার তিনি খুব পছন্দ করতেন।
এটি চাল, বেঙ্গল ছোলা এবং শুকনো ফল দিয়ে তৈরি হতো বলে জানা যায়। আর এই খাবারটি আওরঙ্গজেবের খুব প্রিয় ছিল।
বাহাদুর শাহ জাফরঃ মুঘল রাজা
জনশ্রুতি আছে যে বাহাদুর শাহ জাফর যখনই তার খাবারে চামচ ডুবাতেন, তখন বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা তাঁর দরিদ্র্য প্রজাদের কাছে ঘোষণা করা হতো যে সম্রাট তার খাবার শুরু করেছেন।
আর তখন প্রজাদের মধ্যে বিপুল পরিমাণ চাল বিতরণ করা শুরু হতো। তিনি রুটি, হালুয়া এবং হরিণের মাংস খুব পছন্দ করতেন বলে জানা যায়।
সর্বোপরি মুঘল রাজারা যে খাবারের ব্যাপারে রুচিশীল ছিলেন তাতে কোন সন্দেহ থাকার অবকাশ নেই। আর তাদের খাবারের জন্য যে আয়োজন তাতেও ছিল মহাযজ্ঞ। সেই রাজাদের পৃষ্ঠপেষকতায় এই উপমহাদেশে অনেক নতুন খাবার তৈরী হয়েছে।
খিচুড়ি, নিহারী আমরা প্রতিনিয়ত খাচ্ছি, কিন্তু এই মজার খাবার এর পেছনে যে মুঘল রাজাদের অবদান আছে তা আমরা কয়জন জানি। তাই এখন থেকে যখন এইসব খাবার খাব তখন মনে মনে একবার তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালে ক্ষতি কি।
খিচুড়ি আমার খুবই পছন্দের। অসংখ্য ধন্যবাদ মুঘল দাদাদের আমাকে খিচুড়ি উপহার দিয়ে গেল।ধন্যবাদ
Bah darun to