প্রাপ্তবয়স্ক বক্র কৃমি (Hookworm) ক্ষুদ্রান্ত্রের উপরিভাগে বাস করে । এটা সাধারণত গ্রীষ্মমন্ডলে বেশি দেখা যায়। এই কৃমি ডিম পায়খানার সাথে বের হয়ে মাটিতে মিশে। উষ্ণ ও আর্দ্র মাটি ডিম থেকে কৃমি জন্মের জন্য অনুকূল ।
এই ডিম থেকে কৃমির জন্ম (লার্ভা) নিতে সময় লাগে ৮ থেকে ১০ দিন । খালি পায়ে হাঁটার সময় পায়ের চামড়া ভেদ করে এই লার্ভা শরীরে প্রবেশ করে। শরীরে প্রবেশের স্থানে সামান্য লালমত হয়ে ফুলে উঠে বা চুলকানি হয়। এরপর রক্তনালী দিয়ে হৃৎপিন্ডে আসে। এরপর হৃৎপিন্ড থেকে ফুসফুসে যায়। পরবর্তীতে এটা পেটে গিয়ে পৌঁছায় । এভাবে ক্ষুদ্রান্ত্রের উপরিভাগে পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় ৬ সপ্তাহ ।
১. এই কৃমি রক্ত খায় এবং রক্তক্ষরণ ঘটায়। ফলশ্রুতিতে রোগী রক্তশূন্যতায় ভোগে। ফ্যাকাশে এবং দুর্বল হয়ে যায়। ক্ষুধামান্দ্য থাকে, বুক ধড়ফড় করে এবং পরিশ্রম করতে পারে না । পা এবং শরীর ফুলে যেতে পারে ।
২. অনিয়মিত পায়খানা হয়, পেট ফাঁপে, নরম পায়খানা হয় এবং পেটের নানারকম অসুবিধা হয় । ডায়েরিয়াও হতে পারে ।
৩. পায়ের আঙুলের ফাঁকে বা তলায় সামান্য লাল হয়ে ফুলে উঠা বা চুলকানি প্রাথমিক পর্যায়ে দেখা দিতে পারে ।
৪.কালো পায়খানা হতে পারে।
৫. কাশি থাকতে পারে এবং কখনও বা শ্বাসকষ্টও হতে পারে । ফলশ্রুতিতে রোগী অপুষ্টির শিকার হয় ।
চিকিৎসা ও ডোজ: বক্র কৃমি
১. মেবেনডাজল ট্যাবলেট বা সিরাপ দু’বছর থেকে পূর্ণবয়স্ক সকলের জন্য একই ডোজ ।
প্রতি ট্যাবলেটে আছে ১০০ মিলিগ্রাম এবং প্রতি চা চামচেও আছে ১০০ মিলিগ্রাম।
ডোজ:
১. একটা করে ট্যাবলেট সকালে এবং রাতে পরপর তিন দিন। অথবা ১ চা চামচ করে দিনে ২ বার পর পর তিন দিন ।
২. পাইরেনটেল পামেট ১০ মিলিগ্রাম প্রতি কেজি ওজনের জন্য প্রথম দিন এবং দ্বিতীয় দিন খেতে দিতে হবে ।
কৃমি কি: বক্র কৃমি
অন্য প্রাণীর দেহে অবস্থান করে যে সব জীব জীবন ধারণ ও বংশবৃদ্ধি করে, তাদের পরজীবী বলা হয়। এ সব পরজীবীর মধ্যে যারা অপেক্ষাকৃত বড়, তাদের কৃমি বলা হয়। এরা খুব ছোট (কোন রকমে খালি চোখে দেখা যায়) থেকে কয়েক ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে।
আমাদের দেশে কোন কৃমির প্রকোপ বেশী:বক্র কৃমি
কৃমি অনেক প্রকারের আছে। আমাদের দেশে কয়েক ধরনের কৃমি রোগ সবচেয়ে বেশী। যেমন :
১. কেঁচো কৃমি
২. সূতা কৃমি
৩ . চাবুক কৃমি
৪. বক্র কৃমি
এ ছাড়া, আরো কয়েক ধরনের কৃমিও মাঝে মধ্যে দেখা যায় । যেমন:
৫. ফিতা কৃমি
৬. বেঁটে ফিতা কৃমি
৭. ষ্টংগিলইডিস ষ্টার কোরালিস
৮. পাতা কৃমি
৯. ফাইলেরিয়া
১০. হাইডাটিভ
কৃমি রোগ–এর কারণ :
স্বাস্থ্য অসেচতনতা, অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন জীবন যাপন ও খাবার, পানীয় এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। এ রোগ-এর অন্যতম কারণ ।
সাধারণত কৃমির উপযুক্ত পায়খানা বেশীর ভাগ কৃমি রোগের অন্যতম উৎস। খোলা ও অবৈজ্ঞানিক পায়খানা এ রোগ বিস্তারের অন্যতম সহায়ক উৎস এবং এ উৎস পরিবেশকে দূষিত করলে সে দূষিত পরিবেশে সুস্থ মানুষের শরীরে এ রোগ ছড়ায়।
কৃমি রোগ–এর বিস্তার:
এক-এক ধরনের কৃমি এক- একভাবে আমাদের দেহে প্রবেশ করে। যেমন:
- কেঁচো কৃমি:
এদের ডিম মাটিতে থাকে। সেখান থেকে কাঁচা তরিতরকারী, ফলমূল, হাতের আঙ্গুল, বাচ্চাদের খেলনা ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষের পেটে (অন্ত্রে) প্রবেশ করে।
- সূতা কৃমি :
এ কৃমিরা মানুষের মলদ্বার দিয়ে বের হয়ে মলদ্বারের চারপার্শ্বে ডিম পাড়ে। এখান থেকে ডিমগুলো কাপড়ে, বিছানায়, নখে এবং আঙ্গুলে লেগে যায়। হাওয়ায় ভেসে খাবারের ওপরে পড়ে। এরা সেখান থেকে ডিম গুলো কাপড়ে, বিছানায়, নখে এবং আঙ্গুলে লেগে যায়। হা্ওয়ায় ভেসে খাবারের উপরে পড়ে। এরা সেখান থেকে বাড়ির সকলের পেটে প্রবেশ করে। আক্রান্ত ব্যক্তি নিজের মলদ্বার চুলকিয়ে সে হাতে খাওয়া দাওয়া করলে নিজের কাছ থেকে নিজেই আবার আক্রান্ত হয় ।
বক্র কৃমি ও স্ট্রংগিলইডিস স্টার কোরালিস:
এদের বাচ্চা কৃমিরা মাটিতে খালি পায়ে হাঁটার সময় পায়ের চামড়া ভেদ করে মানুষের দেহে ঢুকে পড়ে।
- ফিতা কৃমি:
এদের বাচ্চা কৃমিগুলো গরু ও শূকরের মাংসে বসবাস করে। এই মাংস কাঁচা বা কম সিদ্ধ অবস্থায় খেলে বাচ্চা কৃমিগুলো মানুষের পেটে প্রবেশ করে। যারা এ খাবার খায়, তারা এ রোগের শিকার হতে পারে।
- বেঁটে ফিতা কৃমি:
এদের ডিম মানুষের মলে থাকে। সেখান থেকে হাতের আঙ্গুল এবং ধূলাবালিতে মিশে খাবারের সাথে আশেপাশের সকলের পেটে ঢুকে পড়ে।
সুতা কৃমি সম্পর্কে জানুন- বিস্তারিত
- পাতা কৃমি:
এদের বাচ্চা কৃমিগুলো জলজ ফলমূল ও তরি-তারকারী শাপলা, পানিফল, পদ্ম ও মাখনা ইত্যাদি)-এর গায়ে লেগে থাকে। এ সব ফলমূল কাঁচা অবস্থায় দাঁত দিয়ে ছিলে খেলে বাচ্চাকৃমিগুলো মানুষের পেটে ঢুকে পড়ে ।
- ফাইলেরিয়া:
ফাইলেরিয়া রোগীকে মশায় কামড়ালে বাচ্চা ফাইলেরিয়া মশার শরীরে ঢুকে পড়ে । পরে এই মশা অন্য সুস্থ লোককে কামড়ালে সে এ রোগে আক্রান্ত হয়।
কৃমি রোগের ব্যাপারে কিছু বহু প্রচলিত কুসংস্কার ও অজ্ঞতা ও ভূল ধারণা:
- এটা কি সত্য যে ইলিশ মাছ বা অত্যধিক মিষ্টি খেলে কৃমি হতে পারে?
- ইলিশ মাছ বা অত্যধিক মিষ্টি বা অন্যান্য খাবার খেলে কৃমি হতে পারে-এ রকম ধারণা একেবারেই অমূলক।
- এটা কি ঠিক যে কৃমির ঔষুধ ঠাণ্ডা বা বৃষ্টির দিনে খাওয়ানো উচিত নয়?
- আজকাল যেসব কৃমির ঔষুধ ব্যবহার করা হয়ে থাকে, তাদের সবগুলোই মোটামুটি নিরাপদ। গরম, ঠাণ্ডা বা বৃষ্টির দিনে যে কোন সময়ে প্রয়োজনে ঔষুধ সেবন করা যায়, এতে কোন অপকার নেই। তবে এসকেরিয়েটিক ক্রাইসিস (Ascariatic Crisis) বা কৃমি উতলা হলে কৃমির ঔষুধ-এর সাথে অন্য ঔষুধও সেবন করতে হয় ।
- অনেক সময় বলতে শোনা যায় যে, পেটে কিছু কৃমি না থাকলে মানুষ বাঁচতে পারে না—এ ধারণা কি ঠিক?
- এটা একেবারেই ভ্রান্ত ধারণা। কিছু কিছু পরজীবী যা অত্যন্ত ছোট, যাদের আমরা ব্যাকটেরিয়া বলে থাকি, অন্ত্রে তাদের কারো কারো উপস্থিতি মানবদেহের জন্যে উপকারী। কিন্তু কৃমি জাতীয় পরজীবীরা কোন উপকার করে বলে জানা নেই; বরং এদের উপস্থিতি মানবদেহের জন্যে খুবই ক্ষতিকর এবং ঝুঁকিপূর্ণ।
- মল পরীক্ষা না করে রোগীকে কৃমির ঔষুধ দেয়া কি যুক্তিযুক্ত:
- মল পরীক্ষা করে রোগীকে কৃমির ঔষুধ খাওয়ানোই ভাল । কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা মল পরীক্ষা না করে কৃমির ঔষুধ দিয়ে থাকি। যেমন:
১. রোগী যদি বলে, তার মলের বা বমির সাথে ইদানিং কেঁচো কৃমি বরে হয়েছে।
২. রোগী যদি বলে যে, তার পায়খানার রাস্তা চুলকায় বা মাঝে মাঝে মলের সাথে সূতা কৃমি বের হয়।
৩. মল পরীক্ষার সুযোগের অভাব কিন্তু কৃমি আছে বলে সন্দেহ।
- মল পরীক্ষার পর কৃমির ডিম নেই বলে রিপোর্ট পেলে কি পেটে কৃমি থাকতে পারে?
- এ রকম পরিস্থিতিতে প্রায়ই দেখা যায়। বিশেষ করে সূতা কৃমির বেলায়। স্ত্রী জাতীয় সূত্য কৃমি গর্ভ অবস্থায় পেটে (অস্ত্রে) বসবাস করে; কিন্তু ডিম ছাড়ার আগে তারা মলদ্বার দিয়ে বাইরে বের হয়ে এসে মলদ্বারের চারপাশের চামড়ার উপরে ডিম পাড়ে। এ কারণে এদের ডিম মল পরীক্ষায় না পাওয়াটাই স্বাভাবিক। বক্র কৃমি
- গর্ভ অবস্থায় কৃমির ঔষুধ খাওয়ানো কি ঠিক?
- যদিও আজকাল অনেক নিরাপদ কৃমির ঔষুধ বেরিয়েছে, তবু অন্য অনেক ঔষুধের মত কৃমির ঔষুধও গর্ভ অবস্থায় প্রথম তিন মাসে না খাওয়ানই ভাল । বক্র কৃমি
- এক ব্যক্তি কি এক সমযে একাধিক কৃমিতে আক্রান্ত হতে পারে ?
- হাঁ, একই ব্যক্তি একই সময়ে একাধিক কৃমিতে আক্রান্ত হতে পারে। বস্তুত এ রকম অবস্থা আমাদের দেশে প্রায়ই দেখা যায়। বক্র কৃমি