তুই জীবনে কি করবি?
তোর দ্বারা কিছু সম্ভব না। অন্যদের ছেলেমেয়ে পড়াশুনায় কত ভাল, আর তুই! এমন বকা-ঝকা
নিত্য দিনের সঙ্গী আমার। স্কুলের স্যাররা সারোয়ার সাহেবের কাছে নালিশ দিল। ভাই আপনার
ছেলেটা খুবই ভাল, শান্তশিষ্ট, ভদ্র, কিন্তু ও যেন কেমন উদাসীন। কি যেন ভাবে, সবসময়ই
আনমনা। আর সেদিন রাতেই বাবার বেধর পিটুনি। ওহ্ জীবন অতিষ্ট। আর ভাললাগে না। যাহ্, আর
বাসায়ই থাকবনা, এবার পালিয়ে যাব।
হা-হা-হা, মশাই!
পালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছেন? সেই মশাইয়ের অবস্থাটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। তার নাম রেজাউল
করিম খান বাপ্পা। স্বভাবে নম্র-ভদ্র, কথা কম বলে, ভাবুক প্রকৃতির। তবে গল্প বলায় সে
সেরা। বন্ধুদের কাছে সবসময়ই বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা বলে। সে একদিন অনুধাবন করল, সে তো
সব সময়ই মিথ্যা কথা বলে। তাই সিদ্ধান্ত নিল, আর মিথ্যা বলবে না। কিন্তু কোন ভাবেই মিথ্যা
ছাড়তে পারছে না। তারপর সে চিন্তা করল, আগামী ১০ মিনিট মিথ্যা বলবো না। এরপরের সপ্তাহে
২০ মিনিট। এভাবে চার মাস যাওয়ার পর বাপ্পা দেখল সে আর মিথ্যাই বলে না। এতে বাপ্পা বুঝতে
পারল যে, সে একটা ভাল কাজ করেছে। কিন্তু এর অনেক দিন পর বাপ্পা অনুধাবন করল, তার যে
মিথ্যা বলার অভ্যাস ছিল তা আসলে মিথ্যা নয়, বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলা।
মূলত একটা বই তাকে
এই উপলব্ধির জন্ম দেয়। বইটি সম্ভবত “সৃজনমীল মানুষ হলে” এই শিরোনামে। এরপর থেকে বাপ্পার
মনে যে মিথ্যা কথা গুলো আসে, সেগুলো খাতায় লিখে রাখে। আর মনে মনে তার আনন্দ হয়। কিন্তু
তার আব্বা আম্মাকে বলে না, যদি মার খেতে হয়। যদি বলে, পড়াশুনা বাদ দিয়ে এখন এসব শুরু
করেছিস!
একদিন পড়ার টেবিলে
বসে আছে বাপ্পা। পড়তে ইচ্ছা না করলেও মাকে দেখানোর জন্য টেবিলে বসে থাকা।
দিনটি ছিল ৭ই মার্চ।
সে মাইকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনছিল। পাড়ার আওয়ামী লীগ অফিসে ভাষণ বাজছেতো বাজছেই। বঙ্গবন্ধুর
এ ভাষণটি শুনলে বাপ্পার গায়ের লোম দাড়িয়ে যায়। বুকে কেমন যেন সাহস আসে, কোথা থেকে যেন
একটা শক্তি পায় বাপ্পা।
এমন সময় বঙ্গবন্ধুর
ভাষণের একটা শব্দ তার টনক নাড়িয়ে দেয়। বঙ্গবন্ধু বলে, “…আর যদি আমার মানুষের উপর
গুলি চালানো হয়…” এই আমার মানুষ কথাটাই তাকে বদলে দিল। আমার মানুষ মানে পুরো বাঙালির
কথা বলছে। অর্থাৎ তিনি ৭ কোটি বাঙালির দায়িত্ব নিয়ে কথা বলছেন, তাই বললেন আমার মানুষ!
বাপ্পা আমার মানুষ শব্দটা নিয়ে সারারাত ভাবলো।
আমি যখন বলি আমার মা, তখন আমার একটা দায়িত্ব আছে।
যখন বলি আমার বাসা তখন এর প্রতি আমার নিজস্ব একটা অনুভূতি কাজ করে। যখন বলি আমার দেশ।
না! সেটা আমি বলতে পারছি না, সেটা বঙ্গবন্ধু বলতে পেরেছিলেন। আমার দেশ কথাটা বললাম
কিন্তু কি দায়িত্ব পালন করলাম দেশের জন্য?
কিন্তু বঙ্গবন্ধু!!
সে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছে, জেল খেটেছে।
কিন্তু আমি বাপ্পা আমার আব্বা আম্মাকেই ভালবাসতে পারলাম না, দেশের জন্য কিছু করা তো
দূরের কথা। সারারাত বাপ্পা এসব নিয়ে ভেবেছে।
পরদিন স্কুলের শিক্ষক
ক্লাসে “ নো দাইসেলফ্” নিয়ে কথা বলল। সক্রেটিসের এই উক্তি তার মধ্যে আবারও নাড়া দিল।
নো দাইসেলফ্ মানে নিজের চাওয়া পাওয়া, আর সুযোগ সুবিধা নিয়ে ভাবা নয়। নো দাইসেলফ্ মানে সবাইকে নিয়ে ভাবা, নো দাইসেলফ্
মানে পৃথিবীকে ভালবাসা। ছোট্ট কথায় অনেক বড়
ব্যাপার আছে।
নো দাইসেলফ্ মানে
আমার আমিকে জানা, আর আমার আমিকে জানতে হলে অন্যকে জানতে হয়। কারণ আমরা একে অন্যের সাতে
ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। শিক্ষকের এসব কথা শুনে বাপ্পার মধ্যে যেন কেমন লাগছে। কি যেন মাথায়
চাপ দিয়ে বসেছে। চিন্তা-চাপা-চিন্তা ওহ্ অসহ্য।
এর মধ্যে বাপ্পা
এস.এস.সি পাশ করে। তবে এখন সে পড়াশুনায় মনোযোগী। কিন্তু গল্প, কবিতা এসব তার ভাল লাগে।
তাই এসব নিয়েও মেতে থাকে। কিন্তু মা বাবাকে বুঝতে দেয় না। কিছুদিন পর বাপ্পা ঢাকায়
যাবে। মামাতো ভাইয়ের সাথে। ময়মনসিংহ স্টেশনে লাইন ধরে দাড়িয়ে আছে টিকিটের জন্য। দেড়
ঘন্টা দাড়িয়ে থাকার পর, টিকিট কাউন্টার থেকে বলা হলো টিকিট শেষ। বাপ্পার মেজাজটা তখন
পুরোই খারাপ। হঠাৎ মামাতো ভাই জনি বললো, চল্ আমার সাথে। জনি ভাই পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকে
গেল স্টেশন মাস্টার এর রুমে। বিশ টাকা বেশি দিয়ে দুটি টিকিট আনলো। ভাই এসে বললো, এই
দেখ টিকিট নিয়ে এসেছি। বাপ্পাতো খুশিতে আত্মহারা। কিভাবে পেলে ভাই? লোকটা যে বললো টিকিট
শেষ। আরে গাঁধা এটা বাংলাদেশ, যেখানে মসজিদের টাকা নিয়ে দুর্নীতি হয়, আর এটাতো সামান্য
টিকিট।
দুইটিকিটের জন্য
চল্লিশ টাকা বেশি দিতে হয়েছে। বাপ্পা যেন মুহূর্তেই ফোটা বেলুনের মত চুপসে গেল। বাপ্পাভাবে
অথচ যে লোকগুলো লাইনে দাড়িয়ে ছিল, ওরা কতইনা কষ্ট করল এই গরমের মধ্যে। টিকিট কাউন্টারের
লোকটা সামান্য কয়টা টাকার জন্য লোকগুলোকে কষ্ট দিল এ অন্যায়।
বাপ্পা জনি ভাইকে
বলে, ভাই কাউন্টারের লোকটা অন্যায় করছে, আর তুমি টিকিট এনেছ এটাও অন্যায়। জনি ভাই হেসে
বলে, ওরে সাধু বাবা এখন সততা দেখালে আজ আর যেতে হবে না। কে মূল্য দেয় তর সততার? রেল
স্টেশনের অফিসার কর্মচারী গিয়ে দেখ সব শালারা চোর। বাপ্পা চুপ চাপ শোনে, আর ভাবে আব্দুল
জব্বার স্যারের ক্লসের কথা। স্যার বলতো মানুষ পড়াশুনা করে মানুষের মত মানুষ হওয়ার জন্য।
সমাজকে উন্নতির পথে
পরিচালিত করার জন্য। এখানে যারা চাকরি করে, সবাই নিশ্চয়ই শিক্ষিত। সবাই মানুষের মত
মানুষ। যদি চুরি করে দুর্নীতি করে তবে ওরা কেমন শিক্ষিত? আর কেমন মানুষ? জনি ভাই বলে,
কিরে কি ভাবিস? চল্ ট্রেন চলে আসবে এখনই।
দেখতে দেখতে বাপ্পা
এইচ.এস.সি ও এইচ.এস.সি পাশ করে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পালা। বেশ কটা বিশ্ববিদ্যালয়ে
পরীক্ষা দিয়েও চান্স হচ্ছিল না। বাসায় হাও মাও করে বাপ্পা কান্নাকাটি শুরু করে। সারোয়ার
হোসেন ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, কাদিস না রে বাপ্পা। দেখ আমাদের সমাজে পড়াশুনা করে
বড় বড় ডিগ্রী নেয় অনেক লোক, কিন্তু মানুষের মত মানুষ আর সার্থক মানুষ কয় জন হতে পারে?
আমি চাই তুই একজন ভাল মানুষ হ।
দেশের বি.সি.এস ক্যাডার,
বড় বড় ডিগ্রী ধারী লোকেরা দুর্নীতি করে, চুরি করে। অথচ সেই চোরদেরকে নিয়েই তাদের বাবা
মা হয়ত গর্ব করে। আমার ছেলে অমুক অফিসার, তার এত প্রভাব প্রতিপত্তি। কিন্তু তার সন্তান
কিভাবে এসব অর্জন করছে তারা তা জানে না। আহ্ আক্ষেপ হয়।
বাপ্পা আমি চোরের
সন্তানের জন্য গর্ব করতে চাই না। এমন অফিসার সন্তান আমার দরকার নেই। আল্লার উপর ভরসা
কর, আর ধৈর্য ধর। অবশ্যই আল্লাহ একটা ব্যবস্থা করে দেবে।
বাবার কথাগুলো বাপ্পার
মনে ঝড় তুলে দিল। কানে বাজতে থাকল ভাল মানুষ, ভাল সন্তান, অফিসার চাই না, ভাল সন্তান
চাই। কিছুদিন পর বাপ্পা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে ভর্তি হল। এখন শুরু হল তার নতুন
মিশন। “নো দাইসেলফ্” ভাল মানুষ, ভাল সন্তান, বঙ্গবন্ধুর সেই আমার শব্দ, মুক্তিযুদ্ধ,
দুর্নীতি। এসব বিষয় নিয়ে তার ভাবনা শুরু। নতুন করে নতুন ভাবে শুরু হবে সব। বাপ্পা প্রথমেই
মানুষের আচরণ নিয়ে গবেষণা শুরু করল অঙ্গভঙ্গি, কথাবার্তা ইত্যাদি।
একদিন বাপ্পা মার্কেটে
গেল বন্ধুর সাথে। সেই বন্ধু রুমান, দোকানদারের সাথে প্রথমেই সালাম দিল, তারপর মুচকি
হাসল। দোকানদার অন্য ক্রেতাদের সাথে তর্ক করছিল, রুমানের সালাম আর হাসি দেখে দোকানদার
নরম স্বরে বলল ওয়ালাইকুম সালাম। তার মুখেও মুচকি হাসি। দোকানদার যেন মুহূর্তেই মোমের
মত গলে গেল। মনে হল যেন রুমান মোমের সলতেতে আগুন জ্বালিয়ে, চারিদিক আলোকিত করে দিল।
বাপ্পা অবাক হল, বাহ্ একটা সালাম আর হাসির এত শক্তি?
এরপর থেকে বাপ্পা
যেকোন দোকানে গেলে সালাম দিয়ে হাসে। দেখে যে দোকানদারের কেমন ব্যবহার। এখান থেকেই বাপ্পার
নতুন চিন্তার জগৎ খুলল। সে মানুষের জীবনের
কিছু পার্ট ভাগ করে নিল। পয়েন্ট আকারে তার ডায়রিতে লিখলো কি কি উপায়ে ভাল ও সুন্দর মানুষ হওয়া যায় এবং কোন
কোন দিক গুলো গুরুত্বপূর্ণ তা লিখলো–
১. সালাম।
২. হাসি।
৩. অন্যকে প্রাধান্য দেয়া।
৪. অন্যের কথা শোনা।
৫. সিদ্ধান্ত নেয়ার যোগ্যতা তৈরী করা।
৬. ভাল ও পজেটিভ চিন্তা করা।
৭. মানুষকে ক্ষমা করতে শেখা।
৮. অর্থ টাকা পয়সা নয় জ্ঞানের পেছনে ছোটা।
৯. সৃষ্টিকর্তার প্রতি আস্থা রাখা।
১০ মনের চাওয়া ও বাস্তবতার সামঞ্জস্যতা করা।
১১ বিশ্বস্ত বন্ধু তৈরী করা।
১২ সময়ের কাজ সময়ে করা।
১৩ নামাজ পড়া।
১৪ অনুমতি নিয়ে কথা বলা।
১৫ আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা বজায় রেখে কথা বলা।
বাপ্পা এভাবে ডায়েরিতে
এসব বিষয় নোট করে। একজন ভাল মানুষ হওয়ার জন্য যা যা করা উচিৎ এই রকম নানা বিষয় সে ডায়রিতে
লিখে। কিন্তু বিপাকে পড়ে, কিভাবে কি শুরু করবে বুঝতে পারে না। তখন তার ছোট বেলার বন্ধুদের
সাথে সেই মিথ্যা বলা এবং মিথ্যা ছাড়ার ঘটনা মনে পড়ে যায়। তাহলে একটা একটা পয়েন্ট ধরে
সে প্রত্যেকটাকে নিজের মধ্যে অভ্যাসে পরিণত করবে। আর বাপ্পা তাই করতে থাকলো।
প্রতিদিনই বাপ্পা
নিজেকে পরিবর্তন করতে চেষ্টা করে। ভাল সন্তান হওয়ার জন্য। ভাল মানুষ হওয়ার জন্য। দুই
বছর যাওয়ার পর বাপ্পা তার বিশ্ববিদ্যালয়ের সবার বিশ্বস্ত এবং কাছের বন্ধু। সবাই তাকে
ভালবাসে। সেভাবে সবার ভালবাসা অর্জন করা সৌভাগ্যের ব্যাপার। এভাবে সে নিজেকে পরিবর্তন
করে, আদর্শ মানুষ হিসেবে তৈরী করতে।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবন
শেষ হলে বাপ্পাকে চাকরির জন্য পায়তারা শুরু করতে হয়। অঙ্ক, ইংরেজি, বাংলা এসব দিয়ে
চাকরিজীবী বাছাই করে আমাদের সরকার। যারা অঙ্ক, ইংরেজি, বাংলা ভাল জানে তারাই মেধাবী।
কিন্তু এতে কি আদৌও মেধাবীদের খুজে পাওয়া যায়? তাহলে একজন ভাল মানুষ কি যোগ্য নয়? একজন
চোর বা দুর্নীতিবাজ ভাল অঙ্ক, ইংরেজি, বাংলা জানতেই পারে। কিন্তু দেশকে বাঁচাতে হলে
দরকার ভাল মানুষ।
একজন চোর অফিসার
হলে সে যতই মেধা সম্পন্ন হোক না কেন সে চুরিই করবে। কিন্তু একজন ভাল মনের বিবেকবান
মানুষ তথাকথিত মেধাবী না হলেও অন্তত দেশকে বিক্রি করবেনা। মানুষকে ঠকিয়ে দুর্নীতি করবে
না, সেই রেল স্টেশনের কাউন্টারের মত।
এমন সময় একজন পিয়নের
ডাক পরে রেজাউল করীম খান। বাপ্পা আতকে ওঠে। আর মনের ভেতরে চলতে থাকা যোগ্য, ভাল মানুষ,
চাকরী এসবের চিন্তা যেন মুহুর্তেই উবে যায়। আমরা আদৌও জানি না বাপ্পার চাকরি হবে কিনা!
যারা ভাইভা নিবে তারা কি সত্যিই বাপ্পাকে বুঝতে পারবে কিনা।
ভাল মানুষ হওয়ার
যে অদম্য চেষ্টা তার কোন মূল্যায়ন তারা করবে কিনা? তবে এটা বলা যায়, বাপ্পার মত এমন
হাজারো বেকার পথে পথে ঘুরছে। যাদেরকে দেশ, সরকার কতটুকু মূল্যায়ন করতে পারে তা নিয়ে
দ্বিধাগ্রস্থ আমরা। তবে আমরা আশা করি বাপ্পার মত মানুষগুলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ভাল
মানসিকতার দৃঢ় সংকল্পে, বাবা মায়ের ভাল সন্তান হয়ে একদিন দুর্নীতিমুক্ত সোনার বাংলা
গড়ে তুলবে।