JANA BUJHA

সাধারণ মানুষের ট্র্যাজেডিঃ ডেথ অফ এ সেলসম্যান

সাধারণ মানুষের ট্র্যাজেডিঃ ডেথ অফ এ সেলসম্যান

সাধারণ মানুষকে জীবনের পথ পরিক্রমায়
পরিবার,
সমাজ, প্রাকৃতিক কিংবা অতি প্রাকৃতিক শক্তির সঙ্গে
সামঞ্জস্য করে চলতে হয়। কিন্তু সব সময়ই মানুষের পক্ষে এ সামঞ্জস্য সম্ভব নয়। মানুষের
নিজস্ব প্রকৃতি কখনো কখনো এমনই বিদ্রোহ করে বসে যে পরিবার বা সমাজের কোন নীতি বা আদর্শের
সাথে তার সংঘাত বাধে। ফলে মানুষ কখনো এমন দুর্বিপাকে জীবনকে নিশ্চিহ্ন করে দেয় কিংবা
জীবনের চারপাশে মহাশূন্যতার শ্মশান সৃষ্টি করে। জীবন চরম বিপত্তিতে নেমে আসে এবং তখনই
মানুষের জীবন এক বিয়োগ ব্যথায় পরিণত হয়।

 

কিন্তু তারপরও মানুষ থেমে থাকে না।
সমাজের মানুষ তার অবস্থান টিকিয়ে রাখার জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে চলে। আর মানুষের
এই সংগ্রামের পথে থাকে সুখ
, দুঃখ, আনন্দ,
বেদনা থাকে স্বপ্ন এবং সেই স্বপ্ন পূরণের আদম্য প্রচেষ্টা। আর এরূপ বাস্তবতার
নিরিখে উনবিংশ শতাব্দীতে নির্মিত হয় মানুষের বাস্তব জীবনের ট্র্যাজেডি।

 

সাধারণভাবে আমরা জানি, মানব জীবনের এক শোচনীয় দুর্ভাগ্যের কাহিনি জীবনের মহাসর্বনাশের এক মর্মান্তিক
ইতিবৃত্ত হল ট্র্যাজেডি। এই ট্র্যজেডির সূচনা বহু বছর যাবৎ নাটকে হলেও এক এক সময়ে এক
এক প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন কারণে সমাজের প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তোলার লক্ষ্যে সেই সময়ের প্রেক্ষাপটকে
কেন্দ্র করে ট্র্যাজেডির রূপেও আসে বিভিন্নতা।

 

সর্বপ্রথম সার্থক ট্র্যাজেডির উদ্ভব
ঘটে প্রাচীন গ্রীসে
, গ্রীক দার্শনিক এ্যারিস্টটলের হাত ধরে। তিনি
ট্র্যাজেডি সম্পর্কে মত প্রকাশ করেন যে
,

ট্র্যাজেডির নাটক হবে উচ্চ মর্যাদা
সম্পন্ন। যাতে থাকবে রাজা বাদশাহদের বিয়োগাত্মক ঘটনার অনুকৃতি
, ভাষা গুরুগম্ভীর, নায়ক হবে আত্মমর্যাদা সম্পন্ন এবং তার
সমস্ত কিছু ভাগ্য দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। 


কিন্তু কাল পরিক্রমায় দেখা যায় যে, সময়েব ব্যবধানে ক্রমে ক্রমে মানুষের চিন্তা চেতনায়ও আসে পরিবর্তন। যার প্রভাব
লক্ষ্য করা যায়
, ঊনবিংশ শতাব্দীতে এসে শিল্প, সংস্কৃতি, রাজনীতি, চিত্রকলা এমনকি
নাটকেও। নিম্নে ঊনবিংশ শতাব্দীর সামাজিক প্রেক্ষাপটের কিছু আংশিক স্বরূপ উপস্থাপিত
হলো:


  • ·        জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রসার
  • ·       
    মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি
  • ·        আবেগ, অবাস্তব ও অলৌকিতাকে পরিহার
    করে মানুষের বাস্তবতার সম্মুখীন হওয়া অর্থাৎ বাস্তবধর্মী চিন্তা চেতনার উন্মেষ ঘটান
  • ·        রাজতন্ত্রকে পরিহার করে গণতান্ত্রিক চেতনায়
    উদ্ভাসিত
  • ·        বংশের উচ্চতার চেয়ে ব্যক্তিত্বের গুন গৌরব
    বৃদ্ধি

 

এ শতকের সামাজিক প্রেক্ষাপটের এরূপ
পরিবর্তনের ফলে শুরু হল জীবন সংগ্রামের বাস্তব চিন্তাচেতনার উন্মোচন। শিল্প সংস্কৃতিতে
আসল নব বিপ্লব। যেই বিবর্তনের ধারাবাহিকতা থেকে বাদ পড়েনি ট্র্যাজেডিও। ট্র্যাজেডির
বৈশিষ্ট্য বিষয়
, ধরণ, উপস্থাপনেও পরিবর্তর আনে সেই
সময়ের নাট্যকারগণ। গ্রীক ট্র্যাজেডির সাথে ঊনবিংশ শতাব্দীর ট্র্যাজেডি পর্যালোচনা করলে
দেখা যায় যে
,

 

প্রথমত, গ্রীক ট্র্যাজেডির নায়কের পরিণতি ভাগ্য দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত। কিন্তু উনিশ
শতকের নায়ক নিজ কার্য বা অর্ন্তনিহিত দুর্বলতার দ্বারা তার পরিণতির পথ রচনা করে।

 

দ্বিতীয়ত, গ্রীক ট্র্যজেডির ভাষা ছিল গুরুগম্ভীর কিন্তু উনিশ শতকের ভাষা ছিল সর্বসাকুল্যের
ভাষা।

তৃতীয়ত, গ্রীক ট্র্যাজেডির নায়ক ছিল রাজা, বাদশা,বা সমাজের উচ্চ বংশীয়  কোন ব্যক্তি।
কিন্তু উনিশ শতকের ট্র্যাজেডির নায়ক ছিল আত্মশক্তিতে বলীয়ান সর্ব সাধারণের মধ্যেই এক
অসাধারণ ব্যক্তি।


চতুর্থত, গ্রীক ট্র্যাজেডিতে অতিলৌকিক ও অবাস্তবতা ছিল, কিন্তু
উনিশ শতকের ট্র্যাজেডি চির সম্পূর্নই বাস্তব নির্ভর।

পঞ্চমত, গ্রীক ট্র্যাজেডিতে নায়কেরা উচ্চ বংশীয় হওয়ায় কোন অভাব অনটন ছিল না। কিন্তু
উনিশ শতকের নায়ক সাধারণ মানুষ হওয়ায় নায়ক এত স্বচ্ছল বা স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল না।


ষষ্ঠত, গ্রীক ট্র্যাজেডি বর্ণনাত্বক ছিল না বরং নাটকীয় , কিন্তু
উনিশ শতকের ট্র্যাজেডি গুলো অনেকাংশেই বর্ণনানির্ভর নাটকীয় গুনসম্পন্ন ছিল।

 

আর এভাবেই গ্রীক ট্র্যাজেডি কাল পরম্পরায়
সময়ের অগ্রমানতায় উনিশ শতকে এসে এক নব রূপে সজ্জিত হয়। কারণ পূর্বে ট্র্যাজেডি কেবল
উচ্চবংশীয়দের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল কিন্তু উনিশ শতকে ট্র্যাজেডির বিষয় হিসেবে সাধারণ
মানুষও রাজা-মহারাজাদের মত সর্বোচ্চ বোধ সম্পন্ন হওয়ায় ট্র্যাজেডি হয়ে ওঠে সর্ব স্তরের
সর্ব সাধারণের ট্র্যাজেডি।


 আরো পড়ুনঃ



 ট্র্যাজেডির এই স্বরূপকে যিনি সর্বপ্রথম আমাদের সমাজে
উপস্থাপন করেন তিনি হলেন বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ট্র্যাজেডি নাট্যকার আর্থার মিলার।
তিনি বিংশ শতাব্দীতে সাধারণ মানুষের জীবনের করুণ পরিণতি নিয়ে একটি নাটক রচনা করেন।
নাটকটির নাম ‘ডেথ অফ এ সেলসম্যান।

 


তিনি এই নাটকে আমেরিকার ব্রুকলিন শহরের
এক সেলসম্যানের জীবনের অতীত ও বর্তমান ক্রিয়া কর্মের বিভিন্ন অনুক্রমের মধ্য দিয়ে মার্কিন
সমাজ জীবনের একটি বিশেষ সমস্যা পুজিবাদী এবং সাধারণ মানুষের অর্ন্তদ্বন্দ্ব খুব সুন্দর
ভাবে উপস্থাপন করেছেন। যা এই নাটকটিকে একটি বিয়োগাত্বক কাহিনিতে রূপদান করেছে।

 

 

এ নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র উইলি লোমান
ছিল নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর একজন সাধারণ মানুষ। তিনি প্রতিদিন সহস্র ক্রোশ পারি দিয়ে
সেলস্ করতে যায়। তার জীবনের স্বপ্ন থাকে অনেক কিন্তু তার প্রাপ্তি খুবই সামান্য। ফলে
তাকে তার জীবনের সাথে প্রতিনিয়তই সংগ্রাম করতে হয়। তার পরিবারে স্ত্রী লিন্ডা ও দুই
সন্তান বিফ ও হ্যাপিকে নিয়ে সমাজে সম্মান নিয়ে বেচে থাকার লক্ষ্যে।

 

 তিনি এত বৃদ্ধ হওয়া সত্বেও সমাজে তার অবস্থান টিকিয়ে
রাখার লক্ষ্যে নিজ আত্মমর্যাদাকে অক্ষুণ্য রেখে প্রাণপন চেষ্টা করেন, কিন্তু শ্রেণী
বৈষ্যমের জাতাকলে বারবার নিপতিত হয়। কিন্তু তারপরও সে তার দায়িত্ববোধ থেকে পিছু পা
হন নি। অদম্য সাহস নিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। যার ফল স্বরূপ হাওয়ার্ডের
কাছ থেকে সে তার চাকরি হারায়।

 


কিন্তু তাতেও তিনি মুষড়ে পড়ে না। বন্ধু
চার্লির কাছ থেকে টাকা ধার করে সংসার চালায় এবং সেই টাকা চার্লিকে ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও
জানায়। আর এসব কারণেই উইলি একজন নিম্নশ্রেণীর সাধারণ মানুষ হওয়া সত্বেও বীরের পরিচয়
দেয়।

 


কিন্তু উইলি তার জীবনের কাজের ভুল, নিজ আত্মঅহংকার ও অহমিকা বোধের কারণে প্রতি মুহূর্তে আত্ম-দ্বান্দ্বিকতায়   ভোগে এবং তিলে তিলে এতে দ্বগ্ধ হয়ে এত অসাধারণত্বের
পরিচয় দিয়েও নিজ কর্ম ফলে নিজের জীবনের করুণ পরিণতি ডেকে আনে।

 


উইলি লোমানের এই জীবন ক্রমের পরিপ্রেক্ষিতে
বলা যায়
,
ডেথ অফ এ সেলসম্যান নাটকের সামাজিক, আর্থ-সামাজিক
সংকট
, বেচে থাকার লড়াই, জীবনাচরণ এবং তার
নিজ কর্ম ভুলের দ্বারা এত অসাধারণত্ব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়া সত্বেও তার
জীবনের যে ঘটনা তা আমাদের জীবনে যে বিয়োগাত্বক পরিণতির উন্মোচন ঘটায় তা একজন উচ্চ বা
নিম্নবিত্ত যেই মানুষই হোক তা কোন অংশেই ট্র্যাজিক পরিণতি থেকে কম নয়।

 

ট্র্যাজিডির বিষয় হিসেবে সাধারণ মানুষ
ও সর্বোচ্চ বোধ হতে পারে তার চারিত্রিক অসাধারণত্ব গুণাবলির মাধ্যমে। যা এই নাটকে
উইলি লোমানের মধ্যেও বিদ্যমান। আর তাই এটি বলাই যায়
, ডেথ অফ এ সেলসম্যান
একজন সাধারণ মানুষের ট্র্যাজেডি।

 

 

 

 

 

Leave a Comment