JANA BUJHA

কোন ঘরে লাইট জ্বালানোর পরও থাকে অন্ধকার?

 

কোন ঘরে লাইট জ্বালানোর পরও থাকে অন্ধকার?

একটা বিলাসবহুল বাড়ি। ডিসেম্পার করা, শীতাতপ
নিয়ন্ত্রিত,দামী সব আসবাবপত্র। প্রকৃতির চিরাচরিত নিয়মে কর্মব্যস্ত দিনের শেষে সে ঘরে
অমানিশার কালো জ্যোতি এসে বিরাজ করে। ঘরে কোটি টাকার জিনিস আছে, শুধু একাটা বৈদ্যুতিক
লাইট নেই। সেই পুরোনো দিনের টিম টিমে খুপি বাতিটা জলছে। কি ভাল লাগবে এমন ঘর? সুস্থ
মানুষতো অবশ্যই না বরং পাগলেও বলবে এ তো সাক্ষাৎ জাহান্নাম।

 

চাইনা এমন ঘর। আলো জালাও অন্ধকার ঘরে দামী
সোফা আর বাহারি আসবাব না থাকলেও হবে অন্তত আলোটা জালিয়ে দাও। হ্যাঁ-ঘরের আলোটা জালাতে
হবে। আর সেই জন্য দরকার বিদ্যুৎ, দরকার সুইচ বোর্ড আর একটা বিদ্যুতিক বাল্ব। তবেই না
অন্ধকার কেটে প্রভায় প্রভাবান্বিত হয়ে আলোর ঢলে হেসে উঠবে, ‘সেই অন্ধকার জাহান্নাম।

 

আচ্ছা বলুনতো আপনার ঘর কি সেই অন্ধকার ঘরটির
মত আছে? নাকি আলোয় জলমল করছে? সমস্যাটা এখানেই পুরুষশাসিত সমাজে যে কোন পুরুষকে এই
প্রশ্নটা করবেন, মনে হবে যেন আকাশ থেকে পড়েছে। কেননা সে জানেই না সে অন্ধকারে না আলোয়
থাকে।

 

আমার আম্মা। খুব হাসীখুশী মানুষ। হঠাৎ কোন
এক দিন দেখি মুখটা ভার করে আছে। কপালের ভাঁজে খালের মত বড় বড় বহমান গর্ত। জল তো নেই
যেন বিষের ঘনঘটা সেই খালে। এতই বিষন্ন আর মনমরা। চাকরী করে সারাদিন বাসার কাজ করতে
করতে যে ক্লান্তির পরশে রাগের কৌটার মুখ খুলে গেছে তা না বললেও দিব্বি বোঝা যাচ্ছে
কাজের গতি দেখে। কিছু ধরলেই যেন ভেঙ্গে ফেলবে, কিছু রাখতে গেলে ধাপধুপ শব্দ।

 

জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে? কথা এড়িয়ে কপালের
ভাজ সরিয়ে হয়নি কিছু কি হবে আবার। আম্মা একটা কথা বলি? তখন সন্ধ্যা সাতটা বাজে হয়ত।
ঘরে এনার্জি বাল্বের আলোয় আরও স্পষ্ট যে আম্মার মেজাজ কত ভয়াবহ।

 

না থাক। বল শুনি কি বলবি? তুমি হাসী খুশী
না থাকলে কেমন যেন সব অন্ধকার দেখি। তোমার মন খারাপ থাকলে বাসায় থাকতেই ইচ্ছা করে না।

আম্মা আমার দিকে তাকিয়ে হা-হা-হা- করে হেসে
দিয়ে বলে। রান্নায় এখনও শেষ করতে পারলাম না, আরও কত কাজ বাকী। যা পড়তে বস গিয়ে। তোমায়
একটু সাহায্য করি আম্মা? তুই পড়তে বস।

 

অবিশ্বাস্য রকম ভাবে মনটা ভাল হয়ে গেল। আম্মা
চলে গেল রান্না করতে। আমি পড়তে বসেছি ঠিকই কিন্তু বইয়ের পাতায় আমার দৃষ্টিই আছে মনের
দৃষ্টি পড়েছে নতুন এক উপলব্ধিতে। কলম আর খাতা নিয়ে সেই উপলব্ধিকে ধরতে হবে।

 

 ছোট
বেলা থেকেই সবার মত আমার দেখা না। আমি ভাবিও একটু অন্যভাবে। তাই সবার ভাবনার সাথে মিল
পড়ে না, সবাই কত সহজভাবে চিন্তা করে, কিন্তু আমি সামান্য বিষয়কেও কতভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে
চিন্তা করি। ভাবতে ভাবতে অন্য কোথায় হারিয়ে যাই। কিন্তু এসব অযথা তাও বুঝি কিন্তু ভাবনা
গুলোকে কোন ভাবেই এড়িয়ে যেতে পারি না। তখনিই উপলধ্বি হলো।

 

আমাদের বাসায় প্রতিটা রুমেই আসবাপ পত্র বা
অন্যান্য যা প্রয়োজনীয় সবই আছে। কিন্তু আম্মা যদি না থাকে তবে সব যেন কেমন প্রাণহীন।
আম্মা যখন কোথাও বেড়াতে যায়, খুবই খালি খালি লাগে বাসায়।

 

ফ্রিজে কত কিছু রান্না করে যায় কিন্তু খেতেও
ইচ্ছা করে না। তবুও বলি আম্মা তুমি আর দুই দিন পড়েই আস, এতদিন পর বাবার বাড়ি গেছ, আমি
এসে নিয়ে আসবনে। আম্মা হেসে বলে তুই খাওয়া দাওয়া করিস ঠিক মত, পড়িস কিন্তু।


 আরো পড়ুনঃ

আব্বা মারা গেল দু‘বছর হলো, কিন্তু অভাব কি
জিনিস বুঝি নি। যখন টাকা লাগে আম্মাকে বললেই বলবে লাগলে তো নিবিই, কিন্তু বেহিসেবি
খরচ করবি না। ভাল একটা পোশাক পড়ি না কেন? দামী জুতা, প্যান্ট, পাঞ্জাবি কত কি না কিনে
দিতে চায় আম্মা। আমার এসবের প্রতি কোন আগ্রহই কাজ করে না।

 

এসব ভাবতে ভাবতেই লাইটার দিকে তাকালাম। দেখলাম
দিব্বি বাতিটি  তার কাজ করে যাচ্ছে। অথচ কিছুক্ষণ
আগে আম্মার মন খারাপে মনে হয়েছিল যেন সবই অন্ধকার, সবই মলিন। তাই মনে হলো আমাদের ঘরের
আলো তো আমার মায়ের মুখের হাসী। যে আলোয় আমরা দুই ভাই দেখতে পাই অন্ধকারকে কাটিয়ে উঠার
সাহস পাই।

 

তখনই মনে হলো এমনতো প্রত্যেকটি ঘরের আলো বাসার
মা, বোন, স্ত্রীরারা।

 

স্ত্রীর হাসি মুখ না দেখলে কি স্বামী আদৌ
ভাল থাকতে পারে? মায়ের মুখেল হাসি ছাড়া কি দুনিয়ার কোন সন্তান ভাল থাকতে পারে? কোন
ভাই কি পারে বোনের হাসী মাখা মুখটি না দেখে?

 

আমাদের বাসায়ই ভাড়া থাকে আমার এক খালাতো বোন।
তার এক ছেলে এক মেয়ে। সারাদিন দুজনে ঝগড়া। মনে হবে এই বুঝি একজন আরেকজনকে মেরে ফেলবে
অথচ মহূর্তেই ঝগড়া শেষ। ঠিকই বোনকে ছাড়া ভাইটি খেতে বসে না।

 

আফুনির মন খারাপ থাকলে ঐ আফুনি তর কি হইছে?
ঐ আফুনি ঐ আফুনি আফুননেয়া তুই এমন করলে কিন্তু তরে মাইর দিব। ঐ আফুনি ঐ আফুনি বলে কান
খেয়ে ফেলে। আমার ভাগ্নি তখন ইচ্ছা না থাকলেও ভাইকে খুশী করতে একটু হেসে বলে কই কি হইছে।

 

তখন ভাইগ্না বলে, মুখটা পেত্নীর মত করে রাখিস
কেন? এই বলে দুই গাল টেনে ধরে হাসানোর জন্য। আর বোনটি দেয় থাপ্পার। তখন ভাইগ্না দৌড়ে
পালায়। কি অদ্ভুত আনন্দ প্রিয় জনের মুখের হাসীতে।

 

মনের ঘরের অন্ধকার দূর হয়ে যায় মায়ের, বোনের,
স্ত্রীর হাসীতে। ঠিক তেমনি আমার মা আমাদের জন্য রান্না করে। কোন সমস্যা হলো কি না কি
করছি , বাজে ছেলেদরে সাথে মিশছি কিনা এসব নিয়েই ব্যস্ত।

আমরা না থাকলে হয়ত আম্মা আর বাঁচতেই চাইতো
না। আমরা আছি বলেই আমার মা এখনও বেতনের টাকাটা তুলেই আগেই আমার এ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে
দেয়। পাঁচশত টাকা বেশি দিয়ে বলে বিকেলে নাস্তা করিস ভাল করে। আম্মা জানে আমি খেতে পছন্দ
করি তাই ফোন দিয়ে বলে খাওয়ার জন্য কষ্ট করবি না টাকা লাগলেই বলবি পাঠিয়ে দিব। ভাল করে
খাওয়া দাওয়া করিস কিন্তু।

 

আবার ঐ দিকে বোনটি ভাইটিকে শাসন করে, পরে
নিজেই আড়ালে গিয়ে কান্না করে। আশা একটাই আমার ভাইটি মানুষ হবে। বড় একজন সফল ব্যক্তি।
আমি সবাইকে বলবো ও আমার ভাই।

 

নিজের খাবারের কিছুটা ভাইকে না দিয়ে খাওয়াই
হয় না। অথচ ভাইটি খাবারে হাত দিলেই দুজনে ঝগড়া করে। কেন আমার খাবারে হাত দিলি অথচ মনে
মনে ঠিকিই চাচ্ছে ভাইকে খাবারের ভাগ দিতে। বরই অদ্ভুত আমাদের ভালবাসা গুলো, বড় অদ্ভুত
আমাদের চাওয়া-পাওয়া।

 


পড়ুুনঃ



এই বিশাল অদ্ভুতের মাঝে আমরা ভাল থাকতে চাই
আমাদের প্রিয় মানুষগুলোর মুখের হাসী দেখে। তাদের ভাল মন্দে তাদের পাশে থেকে নিজেকে
ভাল রাখতে। তাদের জন্য নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে। আর সে জন্যই হয়ত আমার মা আমাদের ভালবাসে,
সে জন্যই আমার বোন দুলাভাইয়ের জন্য খাবার নিয়ে বসে থাকে রাতে এলে একসাথে খাবে বলে,
আর সেই জন্যই বোনটি ছোট ভাইটিকে শাসন করে নিজেই আড়ালে গিয়ে একা একাই কাঁদে।

 

আসলে ঘরের বাল্বটি আমাদের মা, বোন, স্ত্রী।
আর আমরা পুরুষরা হয়ত সেই সুইচ বা বিদ্যুৎ সংযোগ। বাল্ব ছাড়া যেমন বিদ্যুৎ বা সুইচের
কোন মূল্য থাকে না, তেমনি বিদ্যুৎ ছাড়াও বাল্বও অর্থহীন।

 

তাই আসুন আমরা দেখি আমাদের ঘর গুলো সত্যিই
আলোকিত না কি অন্ধকারে হয়ে আছে ?

যে ঘরের নারীর মুখের হাসীটিই মলিন সে ঘরে
হাজার আলোয় আলোকিত হলেও তা অন্ধকার। তাই আমাদের যত্ন আর ভালবাসায় মা বোনদের হাসীমুখে
আলোকিত হোক দেশের প্রতিটি ঘর। এই প্রত্যাশাই আমাদের জানাবোঝা পরিবারের।

 

Leave a Comment