ঈদ
মানে খুশি / আনন্দ। আমরা মুসলমানরা প্রতি বছর দুটি ঈদ পালন করে
থাকি। ঈদুল
ফিতর এবং ঈদুল আযহা ।
আজকে ঈদুল আযহা
নিয়েই কথা বলা যাক। ঈদ মানে আনন্দ আর আযহা মানে কোরবানী
বা ত্যাগ করা। প্রত্যেক বছরই আমরা ঈদুল আযহা পালন করি।
পালন করব বা করা উচিত
অথবা কেন করি এই প্রশ্ন কি কখনো
মনের কোণে উঁকি দেয় না? হয়তো কারো দেয় হয়তো কারো দেয় না। তবে
আমাদের প্রত্যেকেরই জানা উচিত আমরা কেন ঈদ–উল–আযহা
পালন করব।
প্রতিবছর যে উৎসব পালন
করি তা কি শুধু
গরু, মহিষ, উট , ছাগলের গোশত খাওয়ার জন্য করব? নিশ্চয়ই
নয়। এর
পেছনে তাহলে কী কারণ? কেন,
কীভাবে শুরু হলো ঈদুল
আযহা? তাই কেন পালন করব বা কেন করা
উচিত তা জানার আগে
জানতে হবে এর নেপথ্যের ইতিহাস।
ঈদুল আযহা ইতিহাস
মহান আল্লাহ অসংখ্য
নবী রাসূল এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন
মানুষকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়ে আল্লাহর দেখানো পথে চালনা করানোর জন্য। শয়তানের
প্ররোচনায় মানুষ বিপথগামী হয়। আবার
যার মধ্যে সৃষ্টিকর্তার মহত্ব ও বিশালতার মর্ম
উপলব্ধি হয় সে মনেপ্রাণে, ধ্যানে
জ্ঞানে, আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তাঁর নির্দেশিত পথে হাঁটে।
কে
আল্লাহর বিশালতা স্বীকার করে উনার প্রতি অনুগত হয় আর কে অনুগত
হয় না তা দেখবার
জন্য আল্লাহ মানুষকে নানাভাবে পরীক্ষা করেন । তেমনি এক পরীক্ষার সম্মুখীন
হয়েছিলেন মুসলমানদের জাতির পিতা এবং মহান আল্লাহ তাআলার অন্যতম পছন্দের পয়গম্বর ইব্রাহীম (আঃ) ।
জন্ম
থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি বহুবার কঠিন
পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন। যার
মধ্যে অন্যতম পরীক্ষা ছিল আপন পুত্রকে কোরবানি করা। খোদার সন্তুষ্টির জন্য কোরবানী
করার যে প্রচলন তা শুরু হয়েছিল প্রথম মানব আদম (আঃ) এর দুই পুত্র হাবিল
ও কাবিল এর কোরবানী করার নির্দেশের মাধ্যমে।
মহান আল্লাহ কোরআনে বলেন-
আর
আপনি তাদের কাছে আদমের দুই ছেলের (হাবিল ও কাবিল)
সংবাদ যথাযথভাবে বর্ণনা করুন, যখন তারা উভয়ে কোরবানী পেশ করলো। এরপর তাদের একজন থেকে
কোরবানী গ্রহণ করা হল আর অপরজন থেকে গ্রহণ করা হলো না। সে বললো, ” অবশ্যই আমি
তোমাকে হত্যা করবো”। অন্যজন বললো, আল্লাহ কেবল মুত্তাকিদের থেকে কোরবানী গ্রহণ
করেন। (সূরা মায়েদা- আয়াত ২৭)
সেই দুইজনের মধ্যে একজন আল্লাহর উদ্দেশ্যে
পশু কোরবানী করল আর অপরজন কিছু ফসল কোরবানী করলো। সেখানে পশু কোরবানী করাকেই আল্লাহ
গ্রহণ করেছিলেন কোরবানী হিসেবে। তাই
আল্লার সন্তুষ্টির জন্য পশু কোরবানীর প্রচলন হয়েছিল
সেই আদম (আঃ) এর সময় থেকেই। পরবর্তীতে এই দেখানো
পথেই মানুষ আল্লাহর রাস্তায় পশু কোরবানী করতো। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ইব্রাহিম (আঃ)
পশু নয় বরং নিজের সন্তানকেই কোরবানী করতে চেয়েছিলেন।
ইব্রাহিম
(আঃ) ও তাঁর স্ত্রী
বিবি হাজেরার দীর্ঘদিন কোনো সন্তান ছিল না। মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে আকুতি মিনতির পর অবশেষে ইব্রাহিম
(আঃ) ৮৬ বছর বয়সে পুত্র সন্তানের বাবা হলেন। কতটা
প্রিয় আর
সাধনার ধন
তাদের এই পুত্র তা
বলে বোঝানো সম্ভব নয়। যার নাম রাখা হয়েছিল ইসমাইল। একদিন
রবের নির্দেশ এলো- হে ইব্রাহীম, তুমি
তোমার প্রিয় জিনিস রবের উদ্দেশ্যে কোরবানি কর। তিনি
তখন অনেক চিন্তায়
পড়ে গেলেন। কি আছে তার
কাছে প্রিয়? কি
আছে? একদিন
তিনি স্বপ্নে দেখলেন প্রিয়
পুত্র ইসমাইলকে কোরবানী করছেন। তখন
ইব্রাহিম (আঃ) সমস্ত ঘটনা প্রিয় পুত্রকে বললেন। আল্লাহর
নির্দেশ আমি যেন আমার প্রিয়
জিনিস কোরবানি করি আল্লাহর তরে এবং আমি স্বপ্নে দেখেছি তোমাকে আমি কোরবানি করছি। পুত্র
ইসমাইল বললেন, মহান রবকে খুশি
করতে আমি প্রস্তুত। আপনি
আপনার আদেশ পালন করুন। নিশ্চয়ই আপনি আমাকে ধৈর্যশীল রূপে পাবেন।
“এরপর যখন সে তার সঙ্গে চলাফেরা করার বয়সে পৌছালো,
তখন সে বললো, হে প্রিয় পুত্র ! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে জবেহ করছি, অতএব
দেখ এতে তোমার কী অভিমত? ইসমাইল বললো, “হে আমার পিতা, আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে আপনি
তাই করুন। ইনশাল্লাহ আপনি আপমাকে ধৈর্য্যশীলদের অন্তর্ভূক্ত পাবেন। (সূরা- আস সাফফাত,
আয়াত-১০২)
আহা,
কি কঠিন মুহূর্ত! বাবা
ছেলেকে কোরবানি করবে। এই কঠিন মুহূর্তে পিতা–পুত্রকে জবাই করতে গেলে পুত্র বলে পিতা আপনি চোখ
বেঁধে
নেন। চোখে
চোখ পড়লে পিতা হিসেবে আপনি মায়ায় কাতর হয়ে যাবেন। আর আমার হাত-পা বেধে দেন কেননা
যদি আমি মরণ যন্ত্রণার কারণে হাত–পা
ছোড়াছুড়ি করি
তবে আপনি কোরবানী করতে পারবেন না। পিতাপুত্র
কোরবানির জন্য প্রস্তুতি নিল এবং ঠিক যখন জবেহ করার জন্য পিতা
ছুরি চালনা করবে তখন আল্লাহ
খুশি হয়ে ফেরেশতাকে দিয়ে একটা দুম্বা পাঠিয়ে দিলেন। ফেরেশতা
ইসমাইলকে সরিয়ে দুম্বাকে শুয়ায়ে দিলেন তার স্থলে এবং দুম্বা কুরবানী হয়ে গেল। এই
যে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছিল তার প্রেক্ষিতে আজ আমরা ঈদুল আযহা পালন করছি।
কোরআনে উল্লেখ আছে যে, “ নিশ্চয় এটা সুস্পষ্ট পরীক্ষা,
আর আমি এক মহান জবেহের বিনিময়ে তাকে মুক্ত করলাম। আর তাঁর জন্য আমি পরবর্তীদের মধ্যে
সুখ্যাতি রেখে দিয়েছি। ইব্রাহীমের প্রতি সালাম। এভাবেই আমি সৎ কর্মর্শীলদের পুরস্কৃত
করে থাকি”। (সূরা- আস সাফফাতঃ আয়াত-১০৬-১১০)
মহান
আল্লাহ কোরবানীর জন্য স্পষ্ট করেই নির্দেশ দেন- “ আপনার রবের উদ্দেশ্যেই নামাজ পড়ুন
এবং কোরবানী করুন”। (সূরা- কাউছার- আয়াত-২)
কেন আমরা ঈদুল আযাহা পালন করব
মহান
আল্লাহকে রাজি-খুশিঃ
আমরা
যে দুনিয়ায় বেঁচে আছি তার সমস্ত কিছু সৃষ্টি করেছেন মহান আল্লাহ। তাঁকে খুশি করাই আমাদের জীবনের লক্ষ্য ।
তাঁকে খুশি
করার একমাত্র উপায় হলো তিনি যা আদেশ দিয়েছেন তা পালন করা এবং যা নিষেধ করেছেন তা
না করা। আর কোরবানি মহান আল্লাহর আদেশ। তাই
আমরা ঈদুল আযহা/ কোরবানির ঈদ পালন করব, যার একমাত্র উদ্দেশ্য আল্লাহকে খুশি করা।
শিক্ষা হিসেবে অনন্য ঃ সৃষ্টিকর্তা মানুষকে কত ভাবে পরীক্ষা করেন তার একটা নমুনা হচ্ছে
ইব্রাহিম (আঃ) এর পুত্র কুরবানীর ঘটনা। মহান
আল্লাহকে খুশি করতে মানুষ আপন পুত্রকে জবাই
করতে খুশিমনে এগিয়ে যায় যা সত্যিই আল্লাহকে
ভালোবাসার অনন্য নজির। যা আমাদের জন্য দিকনির্দেশনা। কিভাবে সৃষ্টিকর্তাকে ভালোবাসা উচিত আমরা তার শিক্ষা
পাই ইব্রাহিম (আঃ) এর পুত্র কুরবানীর ঘটনা
থেকে।
ত্যাগের
শিক্ষাঃ এই ঈদ পালনের মাধ্যমে আমরা ত্যাগের
শিক্ষা পাই। পিতা হয়ে পুত্রকে জবাই করবে এরচেয়ে
বড় ত্যাগ আর কি হতে পারে। ভোগ নয় ত্যাগেই যে মানুষের সফলতা নিহিত তার একটা শিক্ষা
পাই কোরবানি থেকে।
৮৬ বছর বয়সে পাওয়া পুত্রকে
কোরবানি করার মাধ্যমেই ইব্রাহিম (আঃ) নিজের গর্ব, অহংকার, আনন্দ, স্বপ্ন সবকিছু বিসর্জন
দিয়ে ছিলেন শুধু মহান আল্লাহকে খুশী করতে। তিনি দেখিয়েছেন দুনিয়ায় যে মায়া- মমতা, ভালবাসা তার চেয়েও বড় হচ্ছে আল্লাহকে ভালোবাসা।
মহান আল্লাহ খুশি হলেই একমাত্র সফলতা আসবে।
দুনিয়ায় যে আনন্দ তা সাময়িক। দুনিয়ার সুখ ক্ষণিকের
কিন্তু চিরন্তন সুখতো সৃষ্টিকর্তাকে খুশি করা। তিনি খুশী হলেই মিলবে অনন্ত কালের জন্য
জান্নাত। তাই আমরা নিজেদের রাগ, আনন্দ,শোক, অহংকারসহ যত রিপু আছে তা ত্যাগ করে মহান আল্লাহকে খুশি করব।
আর তাঁর খুশি আমাদের একমাত্র মুক্তি ও সফলতা। ত্যাগের মাধ্যমে যে প্রকৃত মুক্তি মেলে তার শিক্ষা
পাই এই ঈদুল আযহা পালনের মাধ্যমে।
আনন্দ শেয়ার করাঃ ঈদ মানে
খুশি/ আনন্দ। আমরা ঈদের দিন একে অন্যের বাড়িতে
দাওয়াত খাই। আত্মীয়-স্বজন ,পাড়া-প্রতিবেশী সবাই মিলে একসাথে ঈদের নামাজ পড়ি। যারা
চাকরির জন্য বহু দূরে থাকেন তারাও ঐদিন একত্রিত হয় ঈদ পালনের জন্য।
এই যে মিলন মেলা
তৈরি হয় তাতে আমরা আমাদের আনন্দকে ভাগাভাগি করে নেই একে অন্যের সাথে।
নতুন জামা-কাপড়
পড়ে ঘুরতে যাওয়া, সবাই একত্রে কুশলাদি বিনিময়, ভালো ভালো খাবার খাওয়া ইত্যাদি আরো
আনন্দ করি আমরা ঈদ-উল-আযহায়। তাই ঈদ পালনের
মাধ্যমে আমরা একে অন্যের সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করবো।
সমাজের প্রত্যেকেই
প্রত্যেকের তরেঃ
ঈদের দিন আমাদের মধ্যে যারা সামর্থ্যবান
তারা-যাদের কোরবানি করার সামর্থ্য নেই তাদেরকে কোরবানির গোশত বিতরণ করে। ধনী-গরীব ভেদাভেদ
ভুলে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে যে
সৌহার্দ্যপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে
ওঠে তা কিন্তু এই কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করেই। তাই সমাজের প্রত্যেকে আমরা প্রত্যেকের
তরে এই শিক্ষা গ্রহণ করি ঈদুল আজাহা পালনের মধ্য দিয়ে। সুতরাং, নিজেদের সমাজকে ও সমাজের
মানুষের বৈষম্যপূর্ণ মনোভাবকে বদলাতে আমরা ঈদ-উল-আযহা পালন করব।
অর্থনৈতিক
সমৃদ্ধিঃ
কোরবানি ঈদকে কেন্দ্র করে হাজার কোটি টাকার ব্যবসা
হয় আমাদের দেশে। এতে করে নিম্ন মধ্যবিত্ত
ও নিম্নবিত্ত মানুষজন হয়তো সারা বছর যে পশুটি লালন পালন করে তা কোরবানি ঈদে বিক্রি করে পরবর্তী
বছরের খোরাক জোগাড় করে।
অনেক পরিবারই আছে
যারা এই ঈদে পশু বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। তাই দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য
এই ঈদের গুরুত্ব অপরিসীম।
তাছাড়া চামড়া দিয়ে জুতা, বেল্ট সহ আরো নানা চামড়াজাত
দ্রব্য তৈরি হয়, যার কাঁচামাল হচ্ছে পশুর চামড়া। সেই চামড়া সংগ্রহের একটা মোক্ষম সময় ঈদ-উল-আযহা।
তাই ট্যানারি শিল্পের উন্নয়নের জন্য এই ঈদের
গুরুত্ব অতুলনীয়।
আত্মশুদ্ধি ঃ কোরআনে উল্লেখ আছে, “ কিন্তু মনে রেখো, কোরবানীর
গোশত বা রক্ত আল্লাহর কাছে পৌছায় না,আল্লাহর কাছে পৌছায় শুধু তোমাদের নিষ্ঠাসম্পন্ন
আল্লাহ সচেতনতা”। ( সূরা- হজ্ব, আয়াত-৩৭)
যেহেতু কোরবানির রক্ত মাংস কিছুই আল্লাহর কাছে পৌঁছায়
না পৌঁছায় শুধু মানুষের মনের তাকওয়া ও খোদার নির্দেশের প্রতি অনুরাগ ও ভক্তি। সেহেতু নিজেকে আত্মশুদ্ধ করে,নতুন করে নতুনভাবে,
নতুন জীবন শুরু করার দিন হলো ঈদুলআজাহা।
সর্বোপরি আল্লাহর নির্দেশ পালন করে
উনাকে খুশি করা, অহংকার ,রাগ ত্যাগ করা, দুনিয়ার মিছে মায়া ত্যাগ করে চিরন্তন সুখ
ও শান্তির পথ খোঁজা, আত্মশুদ্ধি, সামাজিক সম্প্রীতি ও ভাতৃত্ববোধের জন্ম দেওয়া, অর্থনৈতিক
সমৃদ্ধি ইত্যাদি নানা কারণে ঈদুল আযহার গুরুত্ব অপরিসীম। তাই ব্যক্তি, সমাজ, অর্থনীতি এবং চিরন্তন শান্তির পথকে উন্নত ও সমৃদ্ধ করতে আমরা ঈদ-উল-আযহা পালন করব।
Allahar porikolpona tini e valo janen..