JANA BUJHA

ইট তৈরীর ইতিহাস

 

ইট তৈরীর ইতিহাস
ইট

চারদিকে বিল্ডিং আর বিল্ডং এর সমারোহ আমাদের চোখে
আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে আমরা হয়ত উন্নতির দিকেই হাটছি। আর এই বিল্ডিং তৈরীর অন্যতম
উপাদান হলো ইট। আমাদের মনে কি কখনও প্রশ্ন জেগেছে? ইট তৈরীর ইতিহাসটা তবে কি? কে বা
কারা প্রথমে ইট তৈরী করেছিল? আর বর্তমান সময়ে যে ধরনের ইট আমরা দেখছি আগের ইট কি এমনই
ছিল? আর এইসব প্রশ্নের কারনেই খুব আগ্রহ নিয়ে ইট নিয়ে কিছুটা ঘাটাঘাটি শুরু করেছিলাম।
আর আমার সেই আগ্রহের কথা অন্যকে জানানোর জন্যই ইট তৈরীর ইতিহাস নিয়ে আজকের লিখা। যেহেতু
নিজে জানতে এবং অন্যকে জানাতে ভাল লাগে তাই আজকের এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা।

 

ইট তৈরীর ইতিহাস

প্রাচীন যুগে মানুষ গুহায় বাস করত। নিজেদের উন্নত
করার তাগিদেই হোক আর জীবনমান এর উন্নয়নই হোক , নানা কারণে  মানুষের ঘরের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। অনুমান করা
হয় মানুষ যখন ফসল ফলাতে শুরু করে ঠিক তখন থেকেই ঘর বানাতে শুরু করে। ফসল উৎপাদন, সংগ্রহ
এবং সংরক্ষণ করার জন্য প্রয়োজন পড়ে এক জায়গায় বসবাস করার। ফসল উৎপাদন থেকে সংরক্ষণ
হলো একটি দীর্ঘ মেয়াদী পদ্ধতি।

 

তখন তারা  ঘরের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলো। নিজেদের থাকার জন্য
এবং ফসল মজুদ ইত্যাদি নানা কারণে আদিম মানুষ ঘর বানানোর জন্য বিভিন্ন উপায় বের করলো।
মজবুত ও টেকসই ঘরের জন্য প্রথমদিকে মানুষ গাছের পাতা, ছাল, ডাল ব্যবহার করত। এরপর আস্তে
আস্তে উন্নতির ফলে বর্তমানে আমরা ইটের এবং গ্লাসের তৈরী ঘরে থাকছি।

 

 কিন্তু এই
লম্বা জার্নিটা মোটেও এত সহজ নয়। পুরোপুরি সমস্ত ইতিহাস জানা না গেলেও কিছুটা ইতিহাস
আমরা জেনেছি। আমরা ইট তৈরীর ইতিহাস জানার আগে ঘর তৈরী নিয়ে এই জন্য আলাপচারিতা করে
নিচ্ছি কারণ ঘর তৈরীর প্রয়োজনেই ইট এর তৈরী হয়। তাই আগে ঘর তৈরী নিয়ে কিছু কথা হল।


 আমাদের আলোচ্য
বিষয় যেহেতু ঘরের ইতিহাস নয় তাই ঐদিকে বেশি আলোচনা দীর্ঘ করব না। আমাদের আলোচ্য বিষয়
হলো ইট বা ইটের ইতিহাস। তাই ইটের দিকেই মনোনিবেশ করা যাক।

আরো পড়ুনঃ

মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে ভবন নির্মাণের উদ্দেশ্যে
ইট ব্যবহার করে আসছে। ইতিহাস থেকে জানা যায় খ্রিস্টপূর্ব সাত হাজার সালে প্রথম ইট
তৈরি হয়েছিল। তুরস্কের থ্রি কো শহরের চারপাশে একটি প্রাচীন বসতির সন্ধান পাওয়া যায়
যেখানকার ঘর গুলো ছিল ইটের তৈরী। ধারণা করা হয় প্রথম ইট তৈরী হয়েছিল উষ্ণ জলবায়ুযুক্ত
এলাকায়। তবে  প্রাচীন মিশরীয়রা মাটি দিয়ে
যে ইট তৈরি করতো তারও কিছু প্রমাণ পায় গবেষকরা।

 

মধ্যযুগীয় সময়ে ইট তৈরিতে কাদামাটির ব্যবহার হত।
 শ্রমিকরা তাদের পায়ের সাহায্যে এই মাটির মিশ্রণ
তৈরি করতো। টেবিলের উপর কাঠের ফ্রেম এর সাহায্যে ইটের আকার দেয়া হতো। কাদামাটি যেন
আটকে না যায় সেজন্য বালি বা খড় ব্যবহার করত তারা। অতিরিক্ত মাটি একটি লাঠির সাহায্যে
সরানো হতো।



হরপ্পা  এবং মহেঞ্জোদারো



হরপ্পা  এবং মহেঞ্জোদারোর ধ্বংসাবশেষে থেকে ইটের অস্তিত্ব
পাওয়া যায়। ধারণা করা হয় প্রায় ৩৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এই এলাকায় ইট তৈরী হয়েছিল।
ঐ সময় আগুনে পুড়িয়ে ইট তৈরীর পদ্ধতি  আবিষ্কার
হয়ে গিয়েছিল। এর আগে ইট তৈরী করা হতো সূর্যের তাপ দিয়ে। কিন্তু আগুনে পুড়ে ইট তৈরীর
পর থেকে  আর সূর্যের তাপের জন্য অপেক্ষা করার
প্রয়োজন হতো না। যে কারণে ইট তৈরীর এই পদ্ধতি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। ফলশ্রুতিতে শীতল
জলবায়ু অঞ্চলে এই পদ্ধতি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।



রোমানদের ইট তৈরী


রোমানরা বসন্তেকালে ইট তৈরি করতে
  পছন্দ  করত। তারা ইট নিজে ব্যবহার
করত এবং বিক্রিও করত। ব্যবহারের পূর্বে তারা তৈরী করা ইট দুই বছর সংরক্ষণ করত। রোমানরা
তখন শুধুমাত্র সাদা বা লাল কাদামাটি ব্যবহার করত ইট
তৈরীতে। রোমানদের ইট গুলো অন্যদের থেকে ভিন্ন ছিল। এগুলি সাধারণত গোলাকার, বর্গাকার,
আয়তাকার, ত্রিভুজাকার ছিল। তারা ডিজাইন অনুযায়ী নিজেরা সেই ইটগুলো তৈরী করত।

রোমান সাম্রাজ্যের  সরকারি এবং ব্যক্তিগত ভবনের জন্য ইট ব্যবহার করত।
তারা দুর্গ, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, দালানের গেইট বা মুখ ইট দ্বারা নির্মাণ করতো।

পাম্পেইয়ের হারকিউলিনিয়াম গেইট এবং রোমান কারাকালার
স্নানঘর গুলির রোমান ইটের কাঠামোর উদাহরণ। একটা সময় রোমানদের সাম্রাজ্যে ইট তৈরির শিল্প
প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। যার পেছনে যুদ্ধ-বিগ্রহ ছিল অন্যতম কারণ। কিন্তু তখন ইতালি
এবং বার্জেন্টাইন সাম্রাজ্যে
  ইট তৈরী অব্যাহত ছিল।



পড়ুনঃ



ফ্রান্সের ইট তৈরী

 

১১ শতকে ইট তৈরীর শিল্প ফ্রান্সের দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
১২ শতকের সময় এটি ইতালি থেকে উত্তর জার্মানিতে পুনঃ প্রবর্তন
  করা হয়। তখন লাল মাটির ইট তৈরি হতো। সে সময় ভবনগুলি
লাল মাটির ইট দিয়ে  তৈরি করা হতো। এর উদাহরণ
পাওয়া যায় সুইডেন, ডেনমার্ক, জার্মানি, ফিনল্যান্ড, লিথুনিয়া, বেলারুশ এবং রাশিয়ায়।
এই দেশ গুলোতে পুরাতন অনেক দালান পাওয়া যায় যেগুলো লাল ইট দিয়ে তৈরী। অনেক ধ্বংসাবশেষ
এর প্রমাণ দেয়।

 

তবে সে সময় নানা প্রকার ভাস্কর্যের অভাব লক্ষণীয়।
কেননা ইট দিয়ে ভাস্কর্য তৈরি সম্ভব ছিল না। তারা পাথর
খোদাই করেই ভাস্কর্য তৈরি করতো। কিন্তু বিভিন্ন রং লাল-ইট, চকচকে ইট এবং সাদা চুনের
প্লাস্টারে বিভক্ত ইট ব্যবহার করে যে ভাস্কর্য তৈরী হয়েছিল তা চিহ্নিত করা গিয়েছিল।
অবশেষে ভাস্কর্য তৈরীর প্রয়োজনে তারা  নানা
আকৃতির ইট তৈরী করেছিল। আসলে ইট তৈরীর প্রাক্তন পদ্ধতিকে ব্যবহার করে তারা বিভিন্ন
আকৃতির নতুন ইট তৈরী করতে শুরু করে। আর এই আবিষ্কার ইট তৈরীকে আরও শৈল্পিক করে তুলে।

 


লন্ডনে ইট তৈরী


ইট তৈরীর শিল্প অষ্টম হেনরির সময়ে ব্যাপক উন্নতি লাভ
করে। ১৬৬৬ সালে লন্ডনের বড় অগ্নিকাণ্ডের পরে শহরটি মূলত পুরোপুরি ইট দিয়ে পুনঃনির্মাণ
করা হয়েছিল। এই ইট গুলি ছিল কাদামাটি এবং খড় দিয়ে তৈরি শুষ্ক ইট। যা মধ্য আমেরিকা
থেকে নেয়া হয়েছিল। আর বিশেষ করে মেক্সিকোতে এই ইট শতাব্দী পর শতাব্দী ধরে উৎপাদন হয়েছিল।

ভারজিনিয়ায় ১৬১১ সালে প্রথম ইটের আধুনিক কাঠামো নির্মাণ
করা হয়েছিল বলে ধারনা করা হয়। ১৬২১ সালে খাদ্য ও তেলের বিনিময়ে ভার্জিনিয়া থেকে
বারমোডায় ইট এক্সচেন্জ করা হয়েছিল।

 

 

সবশেষ ১৮৮৫ সাল পর্যন্ত হাতে তৈরি ইট এর ব্যবহার হতো।
কিন্তু এরপর ইট তৈরির যন্ত্র আবিষ্কার হয়। হাতে তৈরীর সময় প্রতি সপ্তাহে ৩৬ হাজার
পিস ইট ইৎপাদন করা যেত। কিন্তু মেশিন দিয়ে দিনে ১২০০০ ইট তৈরি করা শুরু হল।
এর ফলে ইট সহজলভ্য
হতে শুরু করে। আর আস্তে আস্তে সারা পৃথিবী জুড়ে ইটের ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়।


অন্য দিকে বিভিন্ন দেশে লাল ইটের চাহিদা ব্যাপক হারে
বাড়তে থাকে। এর পেছনে অন্যতম কারণ সৌন্দর্য আর অন্য আর একটি কারণ হলো শীতপ্রধান দেশের
ঘরগুলো ঘন কুয়াশায়ও খুব সহজেই দৃশ্যমান
 হয়। কেমন লাগলো ইটের ইতিহাস কমেন্টে
জানাবেন। আর আমরা ইট নিয়ে নতুন আর একটি লিখা নিয়ে খুব দ্রুত হাজির হব ইনশাল্লাহ, সাথেই
থাকুন।
 

0 thoughts on “ইট তৈরীর ইতিহাস”

  1. অসাধারন এবং তথ্যবহুল লেখাজ জন্য অনেক ধন্যবাদ আপনাকে

    Reply

Leave a Comment