আমরা যখন কোন
সমস্যা নিয়ে ডুবে থাকি তখন আমাদের জীবনের ভাল দিকগুলো আর উপলব্ধি করতে পারি না। কারণ
আমাদের মস্তিষ্কে তখন সেই সমস্যাই মূখ্য হয়ে ওঠে। ফলে এই নেতিবাচক ভাবনায়, আমাদের জীবনে
প্রায় সব কিছুকেই সমস্যা আর বিষণ্ণ মনে হয়।
আর এই বিষণ্নতা থেকে
পরিত্রানের জন্য যে পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় তাকে কাউন্সেলিং বা সাইকোথেরাপি বলা হয়। বিশ্বস্বাস্থ্য
সংস্থা (World Health organization, WHO) এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী-
প্রতি চারজনের মধ্যে
একজন মানুষ তাদের জীবনে কোন না কোন সময় মানসিক অথবা স্নায়ুজনিত ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়।
এই মুহূর্তে প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন মানুষ এই অবস্থায় কষ্ট পাচ্ছে। পৃথিবী শুদ্ধ সমস্ত অসুস্থতা
এবং বিকলত্বের পেছনে মানসিক ব্যাধিকে প্রধান সারিতে রাখা হয়েছে। বিষণ্নতা (ডিপ্রেশন)
এখনই সমস্ত বিশ্ব জুড়ে অসুস্থতার মধ্যে চতুর্থ স্থান দখল করে নিয়েছে।
ফলে বর্তমান সময়ে
উক্ত বিষয়টি বিশ্বায়নের প্রেক্ষিতে সর্বক্ষেত্রে একেবারেই দৃষ্টি উপেক্ষিত নয়। এক্ষেত্রে
কাউন্সিলর ফয়সাল আহমেদ মনে করেন-
বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল
দেশের পর্যায়ভূক্ত হওয়ায় এর আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটের ধারা এখনও সেরূপ স্বয়ং সম্পূর্ণ
নয়। তাছাড়া কর্মক্ষেত্রেও যথেষ্ট প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। ফলে এদেশের যুব সমাজের একটি বড়
অংশ উক্ত পরিস্থিতি, পরিবেশ, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রকাঠামোর
ভাবকল্পনায় অনেক ক্ষেত্রে হতাশার সম্মুখীন হচ্ছে।
একুশ শতকের বাংলাদেশের
আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটের ধারায় বলা যায় যে, বাংলাদেশের শিক্ষাক্রম অনুযায়ী বিষয়ভিত্তিক
লেখাপড়ায় যেসব শিক্ষার্থীরা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায় শিক্ষা লাভ করে, তাদের অধিকাংশই
বিষয়ভিত্তিক লেখাপড়ায় কর্মক্ষেত্রে কার্যকারী ভূমিকা রাখতে সেভাবে সক্ষম হয়না।
যেখানে সাহিত্য বিষয়ক পাঠ্যক্রম গুলো অনেকাংশেই এই প্রতিবন্ধকতার
সম্মুখীন হয়ে থাকে বলে ধারণা করা যায়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক প্রাতিষ্ঠানিক নাট্যচর্চা
যেহেতু শিল্প ও সাহিত্য বিষয়ক শিক্ষার একটি পীঠস্থান সেহেতু এই পরিস্থিতিতে এখানে শিক্ষারত
নাট্য শিক্ষার্থীদের ব্যক্তি জীবনে মানসিকভাবে হতাশা গ্রস্থতা অযৌক্তিক কোন বিষয় নয়।
এক্ষেত্রে কাউন্সেলিং প্রক্রিয়ায় যদি ভাষার প্রয়োগে আমাদের মনে নতুন দৃষ্টি ভঙ্গি তৈরী
করা যায়, তবে এই বিষণ্নতা কিংবা উদ্ধেগ গুলো একটি নতুন অর্থ দ্বার করাতে পারে।
কারণ কোন বিষয় সম্পর্কে আমাদের সকলের দৃষ্টিভঙ্গি
এক নয়। ফলে কোন একটি বিষয় সম্পর্কে আমার যে দৃষ্টিভঙ্গি তৈরী হয় তা ব্যক্তি বিশেষ আরেক
জনের কাছে অন্য রকমও হতে পারে। কেননা প্রত্যেকটি মানুষই তার নিজের, অভিজ্ঞতা, পারিপার্শ্বিক
অবস্থা থেকে কোন বিষয়ের উপর ব্যাখ্যা দ্বার করাবে। যার প্রতিটি ব্যাখ্যা একটি অপরটি
থেকে ভিন্ন।
এক্ষেত্রে কোন একজন ব্যক্তি যদি বিষয়টিকে নতুন ভাবে
দেখে অভিনেতার মনে ভিন্ন ইতিবাচক কোন ব্যাখ্যা তৈরী করে, তবে এই ইতিবাচক মনোভঙ্গি সেই
অভিনেতার জীবনের চলার গতির পরিবর্তন আনতে পারে। কারণ তখন অভিনেতার শিক্ষায় তার ব্যক্তি
জীবনের চেষ্টা ও আগ্রহও যুক্ত হবে। যা তার স্বপ্নকে বাস্তবায়নের অভিমুখে নিয়ে যেতে
সাহায্য করবে। যেই প্রক্রিয়াকে ‘কাউন্সেলিংয়ের ভাষায় ‘কগনেটিভ থেরাপি’ বলে অভিহিত করা
হয়।
সাধারণত আমাদের মনে
সর্বদা কোন বিষয় সম্পর্কিত দুই ধরণের দৃষ্টিভঙ্গি তৈরী হয় বলা যেতে পারে। যথা- ইতিবাচক
ও নেতিবাচক। এক্ষেত্রে যদি কোন অভিনেতা নেতিবাচক কোন দৃষ্টি ভঙ্গি দ্বারা প্রভাবিত
হয়। তবে অবচেতন ভাবেই তার মন সেই নেতিবাচক দিকে ধাবিত হয় বলা যেতে পারে।
যেমন- বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক
নাট্যচর্চায় কোন একজন অভিনেতা হয়ত তার অন্যান্য সহপাঠীদের তুলনায় প্রায়োগিক ক্ষেত্রে
তুলনামূলক খারাপ অভিনয় করতে পারে এবং তার বাচিকও ততটা ভাল নাও হতে পারে। ফলে সে একটি
পর্যায় ধরে ন্যায় যে তার দ্বারা হয়ত আর ভাল অভিনয় করা সম্ভব নয়।
আর এই বিশ্বাস তার
মনে এক সময় এমনই প্রগাঢ় হয় যে, নাটকের বড় কোন চরিত্র সম্পর্কে তার মনে এক ধরণের ভীতি
কাজ করে। আর অভিনেতা বিশ্বাস করতে শুরু করে যে তার দ্বারা হয়ত কোন ভাল অভিনয় করা সম্ভব
নয়। আর এই পরিস্থিতিই তখন ঐ অভিনেতার একমাত্র পরিচয়, আর নাট্য জীবনে তার নিয়মিত গল্প
হয়ে ওঠে।
যেই ‘নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বা গল্পকে এলিস মরগান
বলেছেন ‘থিন কনক্লুশনস’ বা নেতিবাচক গল্প। ফলে সে মনে মনে ভাবতে থাকে এই ছোট চরিত্রই
তার জন্য সহজ হবে এবং চরিত্র নির্মাণও ততটা কষ্ট সাধ্য ব্যাপার নয়। কিন্তু এক্ষেত্রে
নাট্যকার স্তানস্লাভস্কির একটি উক্তি যথাযর্থ স্মরণযোগ্য । তিনি বলেন- ‘There are
no small parts, There are only small actors.’ অর্থাৎ অভিনেতা ছোট বড় হতে পারে কিন্তু
কোন ভূমিকাই ছোট নয়।
কিন্তু ঐ অবস্থানে
ব্যক্তি অভিনেতার মনের দিক থেকে হেরে যাওয়াটাই তখন অভিনেতার কাছে যুক্তি যুক্ত মনে
হয়। কাউন্সেলিংয়ের ক্ষেত্রে এই অবস্থা কাটিয়ে উঠার আরেকটি ‘কার্যকারী পদ্ধতি হলো “ন্যারোটিভ
থেরাপি’।’ যেখানে গল্পের মাধ্যমে মানুষের মনের বিষণ্নতা গুলো শোনা হয়।
মূলত মানুষ প্রতিনিয়ত
তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও চিন্তাচেতনায় এরূপ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে বলা যেতে পারে
যে, কোন সমস্যা সম্পর্কে পরিচিত অন্য কারো সাথে আলোচনা কারতেও সংকোচ বোধ করে। কারণ
তার মনের মধ্যে এক ধরণের ভীতি কাজ করে যে, যদি তার মনের সংকটগুলো কেউ জেনে যায় তবে
তার প্রতি ঐ মানুষটির এক প্রকার বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরী হতে পারে।
কিংবা তার সম্পর্কে
নেতিবাচক ধারণারও জন্ম হতে পারে। ফলে কোন বিষয়ে সংকট তৈরী হলে তার নিজের মধ্যেই রেখে
দেয় এবং সেই সংকট গুলোই তার উৎকন্ঠতার কারণ হয়ে দ্বারায়। এক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক নাট্যচর্চায়
একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমার ব্যক্তি জীবনের অভিজ্ঞতা লব্ধ উৎকন্ঠা ও নাট্য শিক্ষার্থীদের
সাথে আলোচনা সাপেক্ষে অভিনেতার উক্ত প্রক্রিয়ার সাথে গমনে তার ব্যক্তি জীবন ও অভিনয়
জীবনে যে ছোট ছোট উৎকন্ঠা লক্ষ্য করা যায় তার কিছু নমুনায়ন তুলে ধরা হল-
·
সকালে উঠে রিহার্সাল ধরতে হবে।
·
রিহার্সালে দেরি হলে শিক্ষক শাস্তি দেবে।
·
সামনে পরীক্ষা। কিছু পড়া হয় নি। পরীক্ষা দিব কিভাবে।
·
চরিত্রায়ন করতে পারছি না।
·
ফোন বন্ধ রিহার্সালে, কেউ ফোন দিল কি না।
·
শরীর খারাপ লাগছে অ্যাসাইনম্যান্ট/ মিড দিতে পারব কি না।
·
রিহার্সাল অনেক রাতে শেষ হলে মেছ বা হলে ঠুকতে পারব কি না।
·
ক্লাসে সঠিক সময় যেতে পারব কি না।
·
বাসায় যাওয়া দরকার। এত কাজ ফেলে যেতে পারব কি না।
এক্ষেত্রে বলা যেতে
পারে এই ছোট ছোট উৎকন্ঠা গুলো প্রত্যেকে তার অবস্থান থেকে একজন অভিনেতার মনে সামান্যই
প্রভাব ফেলতে পারে। কিন্তু যখন এই প্রতিটি উৎকন্ঠাই অভিনেতার মনে মূখ্য হয়ে ওঠে তখন
অভিনেতার মনে এক প্রকার অস্থিরতা তৈরী হয়। যার ফলে অভিনেতা পরীক্ষার দুঃনিশ্চতায় কিছু
পড়তে না পেরে অনেক সময় দেখা যায় পরীক্ষাই দিতে পারে না।
আবার রিহার্সালে
ফোন বন্ধ, কেউ ফোন দিল কিনা সেই চিন্তায় রিহার্সালে মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না। এক্ষেত্রে
ফয়সাল আহমেদ বলেন, ‘এসকল উৎকন্ঠায় মনে মনে হতাশ বা রাগ না হয়ে বরং সচেতন ভাবে অভিনেতার
মনের অনুভূতি গুলো মেনে নেয়াটা জরুরী। যাকে ‘কাউন্সেলিংয়ের ভাষায় বলা হয় ‘মাইন্ডফুল
একসেপ্টেন্স’।
অর্থাৎ অভিনেতা নেতিবাচক ভাবনা গুলোকে পরিহার করে,
বরং যা তাকে বিচলিত করে তুলেছে তার কারণ খুঁজে বের করা এবং উক্ত পরিস্থিতিকে করণীয়
কর্তব্য হিসেবে স্বীকার করে সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করাই যথার্থ হিসেবে উক্ত আলোচনায়
বিবেচিত।